শাহপরীরদ্বীপে সংঘবদ্ধ দূর্বৃত্ত চক্রের কাছে জিন্মি এলাকাবাসী

বিশেষ প্রতিবেদকঃ
কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে সংঘবদ্ধ একটি দূর্বৃত্ত চক্রের কাছে এলাকাবাসী জিন্মি হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, দূর্বৃত্ত চক্রটির সদস্যরা লোকজনকে মিথ্যা মামলায় আসামী করার নামে পুলিশের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, বিনা অজুহাতে চাঁদা দাবি, বিদ্যুতের মিটার-খুঁটি লাইন সহ সরবরাহের নামে মোটাঅংকের টাকা আদায়, ইয়াবাপাচার ও মানবপাচার সহ নানা অপরাধকর্মে জড়িত। এ নিয়ে চক্রটির কাছে প্রতিনিয়ত নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে এলাকার নিরীহ সাধারণ লোকজন।

শাহপরীরদ্বীপের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা কেফায়েত উল্লাহ (৩২) নামের এক যুবকের নেতৃত্বে ১০/১৫ জনের একটি দূর্বৃত্ত দল এসব অপকর্ম সংঘটিত করছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।

চক্রটির কয়েকজন সদস্য চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ পুলিশের কাছে আটক হয়েছিল। তারা কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে বর্তমানে এলাকায় অবস্থান করছে। এখন তারা সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তুলে জড়িয়ে পড়েছে নানা অপরাধকর্মে।

এলাকাবাসী জানায়, দূর্বৃত্ত চক্রটির সদস্যদের দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় সর্বশেষ হয়রানির শিকার হয়েছেন টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপের ডেইলপাড়ার মৃত মতিউর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ সব্বির ওরফে সব্বির বৈদ্য(৫০) এবং তার ছেলে মো. জসিম উদ্দিন (২২)। চক্রটির সঙ্গে যোগসাজশে পুলিশ গত ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শাহপরীরদ্বীপ কোনার পাড়া তেলের পাম্প ও তিন রাস্তার মাথা বাজার সংলগ্ন কুলিংকর্ণার এর দোকান থেকে ১৫৩ টি ইয়াবা পাওয়া গেছে দাবি করে পিতা-পুত্র ২ জনকে আটক করে। 

এ ঘটনায় পুলিশ আটক জসিম উদ্দিনকে মাদক মামলায় আসামী করে জেলহাজতে পাঠালেও সব্বির বৈদ্যকে ১০ দিনের সাজা প্রদান করেন টেকনাফ উপজেলা ভূমি কমিশনার প্রণয় চাকমার ভ্রাম্যমান আদালত। 

হয়রানির শিকার ব্যক্তির পরিবারের স্বজনদের দাবি, এলাকায় গড়ে উঠা দূর্বৃত্ত চক্রটিকে চাঁদা না দেয়ায় যোগসাজশ পূর্বক দোকানে ইয়াবা পাওয়ার দাবি করে পুলিশকে খবর দিয়ে পিতা-পুত্রকে আটক করে মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।

শাহপরীরদ্বীপ কোনারপাড়ার বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ সোনাআলী অভিযোগ করে বলেন, "চক্রটির সদস্য শাহপরীরদ্বীপ ডেইল পাড়ার বাসিন্দা সুলতান আহমদ ওরফে ধইল্ল্যার ছেলে মোহাম্মদ ফয়সালকে (২২) চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা পুলিশ ইয়াবাসহ আটক করেছিল । পরে মামলা ও কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে আসে। 

তিনি বলেন, " ফয়সালের মামা ও বার্মাইয়া ধইল্ল্যার শ্যালক হাফেজ অাহম্মদ ওরফে হাফেজ আাহম্মদ চোরা (৪৩) চুরি,ডাকাতি, ইয়াবা ও মানবপাচার সহ একধিক মামলার আসামী। দূর্বৃত্ত চক্রটির সদস্যারা যোগশাজশ পূর্বক প্রশাসনকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সাধারণ লোকজনকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করে চলছে। "

" চক্রটির আরেক সদস্য কোনারপাড়ার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের ছেলে আকতার হোসেন (২৫) ও কোস্টগার্ডের এক সদস্য গত বছর চট্টগ্রামে ইয়াবাসহ পুলিশের হাতে আটক হয়েছিল। আকতার ৫/৬ মাস কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে আসে" বলে জানান আওয়ামী লীগের এ নেতা।

শাহপরীরদ্বীপের গড়ে উঠা ১০/১৫ জনের দূর্বৃত্ত চক্রটির বিরুদ্ধে ইয়াবাপাচার ও মানবপাচারে জড়িত থাকার পাশাপাশি পুলিশের ভয় দেখিয়ে লোকজন হয়রানিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের বলে দাবি এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান, শাহাব মিয়া ও মোহাম্মদ জালাল সহ আরো অনেকের।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, শাহপরীরদ্বীপ ডেইল পাড়ার বাসিন্দা মৃত মকবুল হোসেন ওরফে মকতুইল্ল্যার ছেলে কেফায়েত উল্লাহ (৩২) এর নেতৃত্বে তার ভাই মো. আতাউল্লাহ (২৭), মনির উল্লাহ (৩০) ও মুজিব উল্লাহ (৩০), কোনারপাড়ার বায়তুল মামুন মসজিদ সংলগ্ন হাবিবুর রহমানের ছেলে আকতার হোসেন (২৫), ডেইল পাড়ার মৃত সুলতান আহমদ ওরফে বর্মাইয়া ধইল্ল্যার ছেলে মো. ফয়সাল (২২) এবং উত্তর পাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে আজম উল্লাহ (৩৫) সহ ১০/১৫ জনের একটি দূর্বৃত্ত দলের কাছে শাহপরীরদ্বীপের সাধারণ লোকজন জিন্মী হয়ে পড়েছে। 

চক্রটির সদস্যরা এলাকার লোকজনকে পুলিশের ভয় দেখি চাঁদা দাবি, নানা অজুহাতে টাকা দাবি, বৈদ্যুতিক মিটার ও খুঁটি সহ লাইন সরবরাহের নামে প্রতারণা পূর্বক টাকা আদায় এবং ইয়াবাপাচার ও মানবপাচার সহ নানা অপকর্ম সংঘটন করে আসলেও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কোন তৎপরতা নেই।

এলাকার বাসিন্দা ছালামত উল্লাহ ও গফুর উদ্দিন বলেন, শাহপরীরদ্বীপের ডেইল পাড়া, কোনার পাড়া ও উত্তরপাড়ার বাসিন্দা চক্রটির সদস্য আজম উল্লাহ টেকনাফ পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ 'সার্ভিস ম্যানের' দায়িত্ব দিয়েছে দাবি করে বৈদ্যুতিক মিটার ও খুঁটি সহ লাইন সংযোগ দেয়ার নামে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে জনপ্রতি ৪/৫ হাজার টাকা আদায় করেছে। অন্তত অর্ধশতাধিক লোকজনের কাছ থেকে চক্রটি আজম উল্লাহকে দিয়ে এসব টাকা আদায় করে নেয়। কিন্তু দীর্ঘ ১বছরেরও বেশী সময় ধরে তারা বৈদ্যুতিক লাইনের সংযোগ পাইনি।

এ নিয়ে আজম উল্লাহকে কখন বৈদ্যুতিক সংযোগ দেয়া হবে খোঁজ নিতে গেলেও ভূক্তভোগী লোকজনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত দূর্ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।

চক্রটির যোগসাজশে পুলিশের হাতে ইয়াবাসহ আটক হয়ে ভ্রাম্যমান আদালতে সাজাপ্রাপ্ত সব্বিরের স্ত্রী ৬ সন্তান-সন্ততির জননী আরেফা বেগম বলেন, বড় ছেলে জসিম তিনরাস্তার মাথায় বাজার সংলগ্ন একটি ছোট কুলিং কর্ণারের দোকান করতো। স্বামী সব্বির ছেলেকে দোকানিতে সহায়তার পাশাপাশি কবিরাজী করে সংসার চালাতো। 

তিনি বলেন, " গত মাসখানেক ধরে এলাকায় তৎপর দূর্বত্ত দলের লোকজন তাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে ইয়াবাসহ পুলিশকে ধরিয়ে দেয়ার হুমকী দেয়। "

আরেফা বেগম বলেন, এ নিয়ে দূর্বৃত্ত চক্রটির যোগসাজশে গত ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে স্বামী ও ছেলেকে দোকান থেকে আটক করে নিয়ে যায়। পরে থানা পৌঁছার পর দোকানে তাদের কাছ থেকে ১৫৩ টি ইয়াবা পাওয়া গেছে দাবি করে আটকের কথা জানায়।


এ ঘটনায় পুলিশের অভিযানকারি কর্মকর্তা ( নাম নিশ্চিত করতে পারেননি ) নাম ভাঙ্গিয়ে চক্রটির সদস্যরা আটকদের ছেড়ে দিতে স্বজনের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেছিল বলে জানান ভ্রাম্যমান আদালতে সাজাপ্রাপ্ত সব্বিরের স্ত্রী।

" অনেক দর কষাকষির পর প্রশাসনিক দেনদরবারের অজুহাত দেখিয়ে এক পর্যায়ে দেড় লাখ টাকা নিয়ে অাসামীদের ছেড়ে দেওয়ায় সম্মত হয়। এতে নগদ এক লাখ ৫০ হাজার টাকাই অভিযানকারি কর্মকর্তাকে দেয়ার নাম করে হাতিয়ে নেয় চক্রটির হয়ে থানার দালাল হিসেবে পরিচিত হাফেজ অাহাম্মদ।

এরপরও পিতা-পুত্রকে শাহপরীরদ্বীপ পুলিশ ফাঁড়িতে ১ দিন আটক রাখার পর ৬ ডিসেম্বর থানায় আনা হলে সব্বিরকে ভ্রাম্যমান আদালতে নেয়া হয়। এতে আদালত তাকে ১০ দিনের সাজা দেন। পরদিন ৭ ডিসেম্বর ছেলে জসিমকে ইয়াবাসহ আটক দেখিয়ে পুলিশ জেল হাজতে পাঠিয়েছে । "

এরপরও পুলিশের অভিযানকারি কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে চার্জশীটে নির্দোষ হিসেবে তুলে ধরে কথিত সিন্ডিকেটটি আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন বলে কয়েকবার ফোনে যোগাযোগে অভিযোগ করেন সব্বির বৈদ্যের স্ত্রী আরেফা। 

বৈদ্যুতিক লাইন সাভির্স ম্যান দাবি করে টাকা আদায়ে অভিযুক্ত আজম উল্লাহ আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, " আমি বিদ্যুৎ মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করলেও টেকনাফ পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কোন ধরণের সম্পর্ক বা যোগাযোগ নেই। বৈদ্যুৎতিক মিটার ও খুঁটি সহ লাইন সংযোগ দেয়ার নাম করে কারো কাছ থেকে টাকা নিইনি। "

আরেক অভিযুক্ত দূর্বৃত্ত চক্রটির মূলহোতা কেফায়েত উল্লাহও তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, সৎভাবে ব্যবসা করে জীবন নির্বাহ করছি। ইয়াবা ও মানবপাচার সহ অপকর্মে জড়িত থাকার তথ্যটি সত্য নয়।

এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে জানতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগটির বিষয়ে তিনি অবগত নন। তারপরও খোঁজ খবর নিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সূত্রঃ দৈনিক সকালের কক্সবাজার!  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ