বাঁশখালীতে কর্মচারীর হাতে দোকান মালিক খুন!


গাজী গোফরান: চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ঘটেছে এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতেই প্রাণ গেছে স্থানীয়ভাবে পরিচিত ব্যবসায়ী নুর আহমদ প্রকাশ দৌলত খাঁনের। হত্যার পর তাঁর দোকান থেকে প্রায় ১২ লাখ টাকা ও এক ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুটের অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও মূল আসামি মো. মান্নান এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। নিহতের পরিবার অভিযোগ করছে, তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃত গড়িমসি করছেন এবং আসামিকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।


ঘটনাটি ঘটেছে গত ৫ অক্টোবর গভীর রাতে, বাঁশখালীর কালীপুর ইউনিয়নের রামদাশ মুন্সিরহাট এলাকায়। রাত দুইটা থেকে পাঁচটার মধ্যে ‘দৌলত খাঁন মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সার্ভিস’-এর ভেতরে সংঘটিত হয় এই হত্যাকাণ্ড। স্থানীয়ভাবে অত্যন্ত পরিচিত ব্যবসায়ী ছিলেন নুর আহমদ প্রকাশ দৌলত খাঁন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ ও বিয়ের অনুষ্ঠানে সাউন্ড সিস্টেম ও লাইট ভাড়ার ব্যবসা করতেন। ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থসহ দীর্ঘদিনের সঞ্চিত নগদ প্রায় ১২ লাখ টাকা ও মৃত স্ত্রীর একভরি স্বর্ণালঙ্কার দোকানের ট্রাঙ্কে সংরক্ষিত ছিল।


প্রায় দুই মাস আগে সাতকানিয়া উপজেলার অন্তর্গত ১৫নং ছদাহা ইউনিয়নের আফজলনগর (৪নং ওয়ার্ড) এলাকার আব্দুল নবীর ছেলে মো. মান্নান (৩০) নামের এক যুবক দোকানে কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন। প্রথমদিকে তিনি নুর আহমদের আস্থা অর্জন করে দোকানের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই আস্থাই পরিণত হয় মৃত্যুফাঁদে।


পরদিন সকালে দোকান বন্ধ দেখে স্থানীয়রা সন্দেহ করেন। বারবার ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া না পেয়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন দেখা যায়, দোকানের মেঝেতে পড়ে আছেন নুর আহমদের নিথর দেহ। অজ্ঞান মনে করে তাঁকে দ্রুত স্থানীয় মা ও শিশু হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। প্রথমদিকে কেউ কেউ ঘটনাটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ধরে নিলেও দাফনের আগে মরদেহ গোসল করানোর সময় শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও রক্তাক্ত ক্ষত দেখে পরিবার ও স্থানীয়দের মধ্যে সন্দেহ জোরদার হয়।


পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে একজন ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্তকারী কর্মকর্তা সহ পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতে সুরতহাল করার জন্য গত ২৩’শে অক্টোবর সকাল নয়টায় নুর আহমদকে কবর থেকে তোলা হয়। সুরতহাল শেষ করে আবারও একইদিন সন্ধ্যা সাতটায় পুনরায় দাফন করা হয়।


দোকানের অপর কর্মচারী ইসমাইল হত্যার পর পলাতক মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার কথাবার্তায় অসংলগ্নতা ও ভয়ভীতির ছাপ দেখা যায়। এতে স্পষ্ট হয়, হত্যার পেছনে মান্নানই মূল নায়ক।


নিহতের মেয়ে ও মামলার বাদী মরজিনা আক্তার সময়ের কণ্ঠস্বর-কে বলেন, “আমার বাবা সারা জীবন পরিশ্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। দোকানের টাকা-পয়সা সবসময় তিনি সযত্নে রাখতেন। কর্মচারী মান্নান ধীরে ধীরে আমাদের পরিবারের আস্থা অর্জন করে। পরে বুঝলাম, সে টাকার লোভে পড়েই বাবাকে হত্যা করেছে। দোকানের ট্রাঙ্কে থাকা নগদ প্রায় ১২ লাখ টাকা আর আমার মৃত মায়ের বিভিন্ন পদের একভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে সে পালিয়ে যায়।”


তিনি আরও বলেন, “ঘটনার পর আমরা থানায় গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। দাফন-কাফনের ব্যস্ততা কাটিয়ে অবশেষে আমি ৮ অক্টোবর বাঁশখালী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশী দরখাস্ত দায়ের করি। আদালত সেটি গ্রহণ করে থানায় পাঠান। এরপর ৩০২/৩৮০/৩৪ দণ্ডবিধিতে মামলা রুজু হয়। কিন্তু মামলা হওয়ার পরও আসামিকে ধরতে পুলিশের কোনো উদ্যোগ নেই।”


মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে বাঁশখালী থানাধীন রামদাশহাট পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) তপন কুমার বাকচীর ওপর। কিন্তু পরিবারের অভিযোগ, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন না যথাযথভাবে।


মরজিনা আক্তার বলেন, “আমরা নিজেরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মান্নান এখন তার গ্রামের বাড়িতে আছে। বিষয়টি বারবার তদন্ত কর্মকর্তা তপন কুমার বাকচীকে জানালেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। আমরা এমনকি যাতায়তের জন্য গাড়ি দিয়ে সহযোগিতার প্রস্তাবও দিয়েছি, কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। মনে হচ্ছে, তিনি আসামির কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছেন। আমরা এখন দিশেহারা–পুলিশ যদি আমার বাবার হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার না করে, তবে আমরা কোথায় যাব?”


এই বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তপন কুমার বাকচীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “ভিকটিম পরিবার এবং মামলার বাদী যে অভিযোগ করেছেন, আসলে সেটি সত্য নয়। নিহত নুর আহমদ প্রকাশ দৌলত খাঁন মারা যাওয়ার পর ৫ই অক্টোবর তার পরিবার তাকে দাফন করে। পরবর্তীতে সন্দেহের উদ্রেক হলে তারা আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশে আমরা মামলাটি এফআইআর করি। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশেই ২৩শে অক্টোবর সকাল ৯টায় বাঁশখালীর এসিল্যান্ড মহোদয়ের উপস্থিতিতে আমরা ভিকটিমের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে সুরতহাল করি। এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে সুরতহাল রিপোর্ট পাইনি। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে, আসামি যেখানে থাকুক না কেন, সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এ বিষয়ে আমরা যথেষ্ট আন্তরিক।”


একই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, “মামলার বাদী যেভাবে বিষয়টি বলছেন, আসলে বিষয়টি তেমন নয়। হত্যা মামলার আসামি গ্রেপ্তার কিছুটা কঠিন। এ বিষয়ে বাঁশখালী থানা পুলিশ যথেষ্ট আন্তরিক। তারপরও বিষয়টি নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”


এই হত্যাকাণ্ডে রামদাশ মুন্সিরহাট এলাকায় চরম চাঞ্চল্য ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, এই ঘটনার মাধ্যমে মানবিকতার সীমা অতিক্রম করেছে লোভ ও বিশ্বাসঘাতকতা।


স্থানীয় ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, “নুর আহমদ ভাই ছিলেন অত্যন্ত সোজা-সাপ্টা মানুষ। কারও সঙ্গে তাঁর কোনো শত্রুতা ছিল না। যে কর্মচারীর ওপর তিনি সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছিলেন, সেই লোকটিই তাঁর জীবন কেড়ে নিল। আমরা এ ঘটনায় হতভম্ব।”


আরেক ব্যবসায়ী জাফর উল্লাহ বলেন, “নুর আহমদ ভাই আমাদের এলাকার সুনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতেন। এমন একজন সৎ মানুষকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা কেবল একটি পরিবার নয়, সমগ্র সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।”


নিহতের মেয়ে মরজিনা আক্তার ও পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাঁরা বিচারপ্রার্থনা করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ছেন। পুলিশের অবহেলা ও আসামির প্রভাবের কারণে তাঁরা আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।


“আমরা শুধু চাই, আমার বাবার হত্যাকারীরা যেন আইনের আওতায় আসে। একজন সৎ ব্যবসায়ীকে যে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার যদি না হয়, তাহলে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হবে,” বলেন মরজিনা আক্তার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ