চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে বিএনপির মনোনয়ন আলোচনায় গুমফেরত আশিক

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের দক্ষিণ উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মনোনয়ন আলোচনায় সবচেয়ে আলোচিত নাম এখন সাবেক ছাত্রদল নেতা মফিজুর রহমান আশিক। দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন, দুই দফা গুম, কারাবাস এবং নির্যাতনের ইতিহাস বুকে নিয়ে এই তরুণ নেতা আবারও ফিরে এসেছেন রাজনীতির ময়দানে–আর তাঁর প্রত্যাবর্তনে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাঁশখালীর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো।

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মফিজুর রহমান আশিক গত কয়েক মাস ধরে মাঠে নেমে গণসংযোগ, কর্মীসভা ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই অক্লান্ত রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিমত।

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই রাজপথে আন্দোলন, প্রতিবাদ ও সংঘর্ষ–এসবই আশিকের নিত্যসঙ্গী। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি ছিলেন তারেক রহমানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বিক্ষোভের অন্যতম সংগঠক। পরবর্তীতে সেনা-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রবিক্ষোভেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায় শুরু হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় রাজধানীর মিরপুর থেকে তাঁকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। গুমের পর দুই মাস অন্ধকার কক্ষে চোখ বাঁধা অবস্থায় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ২০১৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাঁকে হাতিরঝিলে ফেলে রেখে যায় অপহরণকারীরা।

সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করে আশিক বলেন, “গুমকালীন সময়ে আমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা হয়, ঝুলিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। দিনরাতের পার্থক্য বোঝারও উপায় ছিল না। মৃত্যু আমার কাছে প্রতিদিনের সঙ্গী ছিল।”

তিনি আরও বলেন, “গুম থেকে বেঁচে ফেরাটা অলৌকিক। কিন্তু সমাজে, পরিবারে, এমনকি রাজনীতিতেও স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসতে দীর্ঘ সময় লেগেছে।”

প্রথম গুম থেকে ফিরে আসার পরও থেমে যাননি আশিক। বিএনপি ও ছাত্রদলের প্রতিটি কর্মসূচিতে ছিলেন রাজপথে। ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকায় প্রথম মিছিল বের করার সাহসী নেতৃত্বও তাঁরই ছিল।

২০১৭ সালে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতে ওয়ারেন্ট জারির প্রতিবাদে ছাত্রদলের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি মতিঝিল থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন এবং দেড় মাস কারাভোগ করেন। মুক্তি পেয়ে আবারও রাজপথে ফিরে যান।

২০২২ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তাঁকে গুম করা হয়। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর এবং ‘সিটিটিসি কর্তৃক জঙ্গি নাটক মঞ্চায়ন’-সংক্রান্ত তথ্য সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর কাছে সরবরাহের অভিযোগে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। নয় মাস অদৃশ্য থাকার পর রাষ্ট্রদ্রোহ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

এ বিষয়ে আশিক বলেন, “আমাকে দ্বিতীয়বার গুম করা হয় শুধুমাত্র সত্য কথা বলার জন্য। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার প্রতিবেদনে আমার গুমের ঘটনা স্থান পায়–এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য বলেছি।”

২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর সক্রিয় সম্পৃক্ততা ছিল সুস্পষ্ট। আশিক বলেন, আন্দোলনের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। আন্দোলন স্থগিতের আশঙ্কা দেখা দিলে তিনিই গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণার পরামর্শ দেন এবং ১৮ জুলাই থেকে মিরপুরে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের নিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করেন।

তিনি আরও জানান, “ছাত্রনেতারা মুক্তি পাওয়ার পর সাংবাদিক মুশফিক ফজল আনসারী ও বদিউল আলম মজুমদারসহ আমরা একত্রে বসে এক দফা আন্দোলনের রূপরেখা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের বিষয়ে আলোচনা করি। শেখ হাসিনার পতনের পর আমি নিজেই আসিফ মাহমুদকে ড. ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিই।”

বশখালীর রাজনীতিতে মফিজুর রহমান আশিক এখন নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। তাঁর ক্লিন ইমেজ, সাহসী বক্তব্য এবং নির্যাতিত জীবনের কাহিনি স্থান পেয়েছে তৃণমূল কর্মীদের হৃদয়ে।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবুল মনছুর শিকদার বলেন, “গুমফেরত ছাত্রদল নেতা আশিক ভাই ক্লিন ইমেজের অধিকারী। দলের দুঃসময়ে তিনি রাজপথে ছিলেন, যখন অনেকেই পলাতক। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দেশনায়ক তারেক রহমান তাঁকেই বাঁশখালীর প্রার্থী হিসেবে বেছে নেবেন।”

ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, “৩১ দফা ঘোষণার আলোকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আশিক ভাইয়ের বিকল্প নেই। তিনি কখনও ফ্যাসিস্ট দোসরদের সঙ্গে আপস করেননি, বরং তাদের বিচারের দাবি তুলেছেন। এজন্য তরুণ সমাজ তাঁকে নায়ক হিসেবে দেখছে।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মো. ইমরানুল হক বলেন, “বাঁশখালীতে আশিক ভাই এখন অনন্য। তিনি শুধু রাজনীতির প্রতীক নন, তিনি সংগ্রাম ও সত্যের প্রতীক। তাঁর হাত ধরেই বিএনপির মাঠ আবারও জেগে উঠছে।”

মফিজুর রহমান আশিক দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “দেশনায়ক তারেক রহমান বারবার বলেছেন, বিএনপি ত্যাগী ও ক্লিন ইমেজের নেতাদের হাতে দায়িত্ব দেবে। আমি বিশ্বাস করি, বাঁশখালীতে সেই সুযোগ পাব।”

স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, দীর্ঘ দমন-নিপীড়নের ইতিহাস, রাজপথে অবিচল নেতৃত্ব এবং আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত মানবাধিকার কেস হিসেবে তাঁর অবস্থান–সব মিলিয়ে আশিক এখন শুধু একক প্রার্থী নন, বরং ‘ত্যাগী রাজনীতির প্রতীক’।

মফিজুর রহমান আশিকের রাজনৈতিক জীবন যেন বাংলাদেশের সমসাময়িক ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি–যেখানে আন্দোলন, দমন, নির্যাতন ও ত্যাগ মিলেমিশে এক মানবিক আখ্যান তৈরি করেছে। তাঁর প্রত্যাবর্তনে বাঁশখালীর রাজনীতিতে নতুন উন্মাদনা, নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

রাজনীতির মাঠে তিনি আজও একাই বলেন, “আমাকে ভয় দেখিয়ে থামানো যায়নি, যাবে না। আমি সেই বাংলাদেশ চাই যেখানে কেউ গুম হবে না, কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদে নিঃশব্দ হবে না।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ