বাঁশখালীতে শতবর্ষী পুকুর ভরাট কর্মযজ্ঞ! মাটির যোগান পাহাড় কাটা ও ফসলি জমি! পর্ব- ১

এসিল্যান্ড অভিযান চালালেও নেননি দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা! উপজেলা প্রশাসনও চুপচাপ!

মোঃ মনছুর আলম (এম আলম): চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে প্রশাসনের নাকের ডগায় শতবর্ষী দারগা পুকুর প্রায় ভরাটের পথে। পৌরসভার জলদী মিয়ার বাজারের পূর্ব পার্শ্বে চৌধুরী মার্কেটের পেছনে নতুন মার্কেট নির্মাণের জন্য পাহাড় কেটে ও ফসলি জমির মাটি এনে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। আইন লঙ্ঘন করে দিনদুপুরে পুকুর ভরাটের কর্মযজ্ঞ চললেও উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন সাক্ষী গোপালের ভূমিকায় থেকে ‘চুপচাপ’! অথচ যে কোন ধরণের পুকুর ভরাটে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং জেলা প্রশাসকের স্পষ্ট নির্দেশনা পুকুর ভরাট বন্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম আদালতের এডভোকেট মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ হোছাইনী বলেন, পরিবেশ আইন-১৯৯৫ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ এর বিধান অনুসারে যে কোন জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় ব্যক্তিগত পুকুর হলেও জলাধার সংরক্ষণ আইনে তা জলাধারের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভরাট করা যাবে না। পরিবেশবিদরা বলেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে পরিবেশ রক্ষায় পাহাড়ের প্রয়োজন অপরিসীম। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর বিধান অনুসারে শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোন পাহাড় কাটা যেতে পারে। এদিকে কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। আর সেই মাটি কাটা হলে জমির জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফলে খাদ্য উৎপাদনে দেশে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তাই ফসলি জমির মাটি কাটা বেআইনি।

এরই মধ্যে এসিল্যান্ড {উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)} ঘটনাস্থলে অভিযান চালালেও অবৈধ মাটি সরবরাহকারী ও পুকুর ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। নামকাওয়াস্তে এই অভিযানের পরপরই পুকুরের খোলামেলা অংশে সীমানা প্রাচীর তৈরী করা হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে বিরতি দিয়ে দিয়ে সুযোগ বুঝে রাতের আধারে চলছে পুকুর ভরাটের কার্যক্রম। "যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন" এ ঘটনায় অভিযান পরিচালনাকারীর ভূমিকা ঠিক যেন তাই।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এতটাই সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত ছিল অবাধে ব্যবহার দূরের কথা একসময় মানুষ শতবর্ষী এই দারগা পুকুরের পানি পান করত। সরজমিনে দেখা যায়, পুকুরটির আশেপাশে রয়েছে দোকানপাট, কাঁচাবাজার, ছোট-বড় মার্কেট, স্কুল-কলেজ সহ জনগুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা ও বসবাসের ঘরবাড়ী। এসবের অগ্নিকাণ্ড-নির্বাপন পানির অন্যতম উৎস শতবর্ষী এই দারগা পুকুর। পরিবেশ রক্ষার্থে ও যেকোন অগ্নিকাণ্ড-নির্বাপনে অপরিসিম ভূমিকা রাখায় এই পুকুরটি ভরাটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট জোর দাবী জানান এলাকাবাসী ও দেশপ্রেমি সচেতন মহল।


গোপন সূত্রে জানা যায়, পুকুরটির অংশীদার জনৈক অলক উপজেলার সরল ইউনিয়নের জালিয়াঘাটা এলাকার প্রবাসী হুমায়নের নিকট তার প্রায় ২২ শতক পরিমাণ অংশ বিক্রি করেন। ক্রয়সূত্রে বর্তমান মালিক হুমায়ন তার কেনা অংশটি ভরাট করে মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। একটি মহল অর্থের লোভে অবৈধ ভাবে পাহাড় কেটে ও ফসলি জমি থেকে মাটি যোগান দিয়ে শতবর্ষী এই দারগা পুকুরটি নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এসবের দেখবালের দায়িত্বে আছেন পুকুরের ক্রীত অংশের কেয়ারটেকার হিসাবে ফোরকান নামের এক ব্যক্তি। এছাড়াও গেল বছর স্থানীয় এক দোকানদার আগামী ৫ বছরের জন্য মাছ চাষের লক্ষ্যে সকল অংশীদারের নিকট থেকে পুকুরটি লিজ নেন। বছর না যেতেই পুকুর ভরাটের কর্মযজ্ঞ শুরু হওয়ায় লোকসানের আগাম হিসাব কসতে হচ্ছে তার। এ যেন ৫ বছর সমান ১ বছর! এই বিষয়ে কেয়ারটেকার ফোরকানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, 'তার নাম সাইফুল, বাড়ী সাতকানিয়া' পরিচয় দিয়ে ভুল নাম্বার বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ বছর ফেব্রুয়ারীর শুরুতে পুকুরটি ভরাটের কার্যক্রম চালু করে। শুরুতে মাটি ফেলে পুকুরের পশ্চিমাংশ ভরাট করা হয়। সেসময় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ের অভিযানে পুকুরটি ভরাটে জড়িতদেরকে নিষেধ করা হলেও রহস্যজনকভাবে দৃশ্যত কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। এর পরপর উপজেলা প্রশাসনের রহস্যজনক এমন নীরবতায় সীমানা প্রাচীর দিয়ে বিভিন্ন সময় রাতে আবারো মাটি ফেলে পুকুরটি ভরাটযজ্ঞ অনেকাংশ সফল করে। তখনও উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এখন অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী মহলের মধ্যস্থতায় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই পুকুরটি ভরাট করে মার্কেট নির্মাণের জন্য নেমেছে বর্তমান মালিকপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, যেকোন কিছুর বিনিময়ে পুকুর ভরাট করে মার্কেট নির্মাণ করবেই! এমনটাই জোর গলায় বলে বেড়াচ্ছেন তারা। এই নিয়ে আরো সরেজমিন তদন্ত, মতামত ও প্রমাণিত বিষয়াদির উপর ধারাবাহিক প্রতিবেদন চলবে।

এ বিষয়ে জানার জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল খালেক পাটোয়ারীর মুঠোফোনে একাধিক ফোন করেও রিসিভ না করায় গত ২০ ফেব্রুয়ারী তার কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। একইদিনে বক্তব্য নেওয়ার উদ্দেশ্যে বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তোফায়েল আহমেদ এর সাথে সাক্ষাতের চেষ্টায় থানার সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করার পরও ওসির জনসংযোগ ব্যস্ততায় সাক্ষাত করা সম্ভব হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, পুকুর ভরাটের কোন সুযোগ নেই। ভরাট করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং নিজ খরচে পুনঃখনন করে দিতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ