বাঁশখালীতে কাবিখায় অন্তর্ভুক্ত সহস্রাধিক শ্রমিক মজুরি বঞ্চিত

বাঁশখালীতে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির (কাবিখা) ৪০ দিনের প্রকল্পে শ্রমিকদের ব্যবহার না করে স্কেভেটর দিয়ে কাজ চলছে। উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ৬২ প্রকল্পের আওতায় তালিকাভুক্ত ২ হাজার ৯শ ১৭ জন শ্রমিকদের কোথাও ব্যবহার করা হচ্ছে না। বেশিরভাগ প্রকল্পে স্কেভেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও ভুয়া প্রকল্প রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২ হাজার ৯শ ১৭ জন শ্রমিকের মজুরির জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যাংকগুলোতে শ্রমিকদের নামে একাউন্ট করা হয়েছিল সরকারিভাবে। কতিপয় চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, প্রকল্প চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট অফিসাররা কৌশলে শ্রমিকদের মজুরি বঞ্চিত করেন। গত বছর শ্রমিকদের দৈনিক ২০০ টাকা বেতনের ৪০ দিনের ৮০০০ টাকা মজুরি ব্যাংক থেকে ওঠানোর পরই সংশ্লিষ্ট প্রকল্প চেয়ারম্যানরা কেড়ে নেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপকের সামনেই। আট হাজারের পরিবর্তে শ্রমিকরা পেয়েছিলেন ৫০০-১০০০ টাকা।
এ বছরেও একই কায়দায় ৬২ প্রকল্প স্কেভেটর দিয়ে চলছে। কোন সরকারি তদারকি নেই। ওইসব প্রকল্পের ২ হাজার ৯শ ১৭ জন শ্রমিকের মোট ২ কোটি ৩৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকার মজুরি নিয়ে লুটপাটের পরিকল্পনা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বাঁশখালীর ১৪ ইউনিয়নে সরেজমিন ঘুরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অসংখ্য শ্রমিক অভিযোগ করে বলেন, গত ২০ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া ৪০ দিনের কর্মসূচির কাজ শেষ হবে ৩০ জুনের মধ্যে যে কোনদিন। ৬২ প্রকল্পের সবগুলোই স্কেভেটর কিংবা ট্রাকে মাটি সরবরাহের কাজ চলছে। কোথাও শ্রমিক নেই। ৪০ দিনের কর্মসূচিতে তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার পরও কাজে নিয়োগ করে না। ৪০ দিনের কাজ শেষ করা হয় ৩/৪ দিনে। সরকারি কোন কর্মকর্তা এসব বিষয়ে তদারকি করছেন না। শ্রমিকরা প্রতিবাদ করলে হুমকি ও নানা হয়রানির ভয় দেখায়।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণ খাল খননের নামে মাছের প্রজেক্ট বর্ধিত করা হচ্ছে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির প্রকল্পের আওতায়। ৩৭ শ্রমিকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে স্কেভেটর। অথচ ৩০ বছর ধরে বাহারছড়া ইউনিয়নের চাপাছড়ি গ্রামের ইন্দ্র নারায়ণ খালের কিছু অংশ বিলীন হয়ে ভরাট জমিতে পরিণত হয়েছে। আগে সেখানে খাল ছিল। এখন সেখানে মাছের প্রজেক্ট হয়েছে। ওই মাছের প্রজেক্ট বর্ধিত করা হচ্ছে ইন্দ্র নারায়ণ খাল খননের নামে।
প্রকল্পের সভাপতি স্থানীয় ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিন খান বলেন, এলাকাবাসী মাছের প্রজেক্ট করেছিল আমি তা স্কেভেটর দিয়ে খালে পরিণত করছি। এখানে কোন দুর্নীতি হচ্ছে না। অন্যদিকে এলাকাবাসীরা বলছেন, যেদিকে খাল খনন করা দরকার সেখানে খাল খনন না করে ভিন্ন দিকে খাল খনন করে মাছের প্রজেক্ট করা হচ্ছে, খনন করা মাটি বিক্রয় করা হচ্ছে।

জানা যায়, পুঁইছড়ি ইউনিয়নের পূর্ব পুঁইছড়ি কাছেম আলী সড়ক প্রকল্পের শ্রমিক সংখ্যা ৫৩ জন। ওই প্রকল্পের চেয়ারম্যান সংরক্ষিত ইউপি সদস্য রেহেনা বেগম। তিনিও স্কেভেটর দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকের পরিবর্তে স্কেভেটর কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘পুরো বাঁশখালীতে যেভাবে কাজ হচ্ছে সেভাবে আমিও করছি।’
একই ইউনিয়নের ১০৫ শ্রমিকের জেলেপাড়া রোড ও রুস্তমঘাটা সড়কের প্রকল্প চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিন, ৫৩ শ্রমিকের মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী সড়কের প্রকল্প চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য খানে আলম চৌধুরী, ৫৪ শ্রমিকের মকসুদা খাতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ভরাট প্রকল্পের চেয়ারম্যান ইউপি সদস্য আবুল কাশেম। প্রত্যেকে একই সুরে বলেন, শ্রমিক দিয়ে কাজের মান সুন্দর হয় না। তাই সবার মত আমরাও স্কেভেটর ব্যবহার করছি। ওই ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার উপজেলা প্রাথমিক রির্সোস সেন্টার কর্মকর্তা মো. সেলিম বলেন, ‘প্রকল্পের যে কাজ হচ্ছে তা আমি জানি না। খোঁজ নিয়ে তদারকি করব।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন চৌধুরী খোকা বলেন,‘ আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত চেয়ারম্যান। জনগণ চায় কাজ। দৈনিক ২০০ টাকা দামের শ্রমিক দিয়ে কাজের মান সুন্দর হয় না। বদনাম হয়। শ্রমিকও পাওয়া যায় না। এছাড়াও এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে শ্রমিকের পরিবর্তে স্কেভেটর দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তবে শ্রমিকরা কাজ না করলেও কিছু মজুরি তাদের দেয়া হবে।’
খানখানাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মো. বদরুদ্দিন বলেন, ‘শ্রমিক, স্কেভেটর, ট্রাক সব মিলিয়ে কাজ হচ্ছে। রাস্তার কাজের ধরন বুঝে পদক্ষেপ নিতে হয়। সম্পূর্ণ কাজ শ্রমিক ছাড়া হচ্ছে না।’
একইভাবে পুকুরিয়া ইউনিয়নে গিয়ে ৫ প্রকল্পের কাজ স্কেভেটর এবং ট্রাকে মাটি দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। এ ব্যপারে পুকুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আসহাব উদ্দিন বলেন, আমার ইউনিয়নের পাঁচ প্রকল্প আমি তিনমাস আগেই শেষ করেছি। সব প্রকল্প শ্রমিক দিয়েই করেছি। এখানে কোন স্কেভেটর ব্যবহার হয়নি। ২০ এপ্রিলের শুরু হওয়া প্রকল্প তিনমাস আগে কিভাবে শেষ হলো? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান।
শেখেরখীল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন বলেন, আমার এলাকায় প্রকল্প মাত্র তিনটি। প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই আমি কাজ করে ফেলেছি। শ্রমিক দিয়ে করেছি। স্কেভেটর দিয়ে নয়। ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন বলেন, ‘আমার এলাকায় ৪০ দিনের প্রকল্প শুরুই হয়নি। সেখানে স্কেভেটর ব্যবহারের প্রশ্নই আসে না।’ স্কেভেটর দিয়ে চলমান ৪০ দিনের কর্মসূচির কয়েকটি প্রকল্পের নাম উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘ওইসব অন্য প্রকল্পের কাজ।’ বৈলছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. কফিল উদ্দিন বলেন,‘আমার পাঁচ প্রকল্পে স্কেভেটর দিয়ে শুধুমাত্র কিছু কিছু জায়গায় কাজ করেছি। তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশনা নিয়েই করা হয়েছে। অন্য জায়গায় শ্রমিক ব্যবহার করা হয়েছে।
ওই ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা শাকেরা শরীফ বলেন,‘আমি প্রকল্পগুলো দেখব এবং শ্রমিকদের জিজ্ঞাসা করব। স্কেভেটর দিয়ে কাজ করতে দেখিনি।’
উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম মিয়াজি বলেন, ‘বাঁশখালীতে ৬২ প্রকল্পের জন্য তালিকাভুক্ত শ্রমিক ২ হাজার ৯শ ১৭ জন। প্রত্যেকের ব্যাংক একাউন্ট আছে। ৪০ দিন শেষে শ্রমিকদের একাউন্টে মজুরি জমা হবে। এখানে স্কেভেটর দিয়ে কাজ করার কোন বিধান নেই। কোন প্রকল্প চেয়ারম্যান বা নিযুক্ত ট্যাগ অফিসাররা বিষয়টি সঠিক তদারকি না করেন তাহলে আমার কিছু বলার নেই। তারপরও বিষয়টি তদন্ত করা হবে।’
কৃষি ব্যাংক নাপোড়া শাখার ব্যবস্থাপক মো. বদিউল আলম চৌধুরী বলেন,‘আমরা শ্রমিক ছাড়া কাউকে মজুরির টাকা দিই না। ওই টাকা ব্যাংকের বাইরে কেউ কেড়ে নিলে আমাদের করার কিছু নেই। ওইটা শ্রমিকদের ব্যাপার। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অভিযোগ করতে পারেন।’
বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার বলেন, ‘৪০ দিনের কর্মসূচি তদারকি করার জন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার রয়েছে। শ্রমিকদের পরিবর্তে স্কেভেটর ব্যবহার করার অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে। শ্রমিকদের মজুরি অনুসারে প্রাপ্য মজুরি পাওয়া উচিত।’
/চট্টগ্রাম প্রতিদিন!  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ