বাঁশখালীতে নিয়মিত চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির সুযোগে প্রাইভেটে রোজগার অন্যদের

বাঁশখালী ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হাসপাতালের নিয়মিত চিকিৎসকদের অনেকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক হওয়ার প্রভাবে সপ্তাহে ২/১ দিন করে কর্মস্থলে উপস্থিত হন বলে রোগীদের অভিযোগ। নিয়মিত চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে কক্সবাজারের সরকারি হাসপাতালের ৪ চিকিৎসক বাঁশখালী হাসপাতাল গেটে চেম্বার খুলে সকাল থেকেই ৫শ টাকা ফি নিয়ে রোগী দেখে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরদারি না থাকায় বাঁশখালীতে রোগীদের হয়রানির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাঁশখালী হাসপাতালে ডাক্তারদের কর্মস্থলে উপস্থিতি প্রমাণের জন্য ২ বছর পূর্বে বায়োমেট্রিক যন্ত্র স্থাপন করা হলেও সঠিক তদারকি না থাকায় চিকিৎসকরা নিয়মিত কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে চাকরির বেতন-ভাতা গ্রহণ করছেন। হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাঁশখালী উপজেলায় প্রায় ৭ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকায় ১৯৮০ সালে বাঁশখালী হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮ বছর পূর্বে এ হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েদের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রসূতি বিভাগ চালু করা হয়। ৩/৪ বছর প্রসূতি বিভাগে অপারেশন কার্যক্রম চলমান থাকলেও তা পরবর্তী ১৫ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। গর্ভবতী মহিলারা নগরীতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে পথের মধ্যে মৃত্যুবরণ করছেন। এ হাসপাতালে দুই বছর পূর্বে ৩৩ জন চিকিৎসক থাকলেও বর্তমানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ১৩ জন চিকিৎসক রয়েছেন। নিয়মিত হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগে ভর্তির তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা কম। এরপরেও হাসপাতালে নিয়োগকৃত দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরাও প্রতিদিন অফিস সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকে না। ফলে সঠিক তদারকি না থাকায় রোগীরা সরকারের ঘোষিত উপযুক্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সপ্তাহে ২ দিন করে চট্টগ্রাম শহরের বাসা-বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করে কর্মস্থলে উপস্থিত হন। বৃহস্পতি ও সোমবার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হাসান আরিফ, রবিবার-বুধবার চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সবুজ ধর, রবিবার ও মঙ্গলবার গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোজিনা আহমেদ কর্মস্থল বাঁশখালী হাসপাতালে উপস্থিত হয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে ডাক্তার জুবরিয়া শারমিন দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময় কয়েকজন রোগীকে চিকিৎসা সেবাপত্র লিখে দিয়ে নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দিতে দেখা দেছে। বয়োবৃদ্ধা মহিলাকে চিকিৎসা সেবার জন্য কয়েকটি পরীক্ষাও লিখে দিলেন তিনি। এ সময় সহকারী জানালেন, সকাল থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৩১ জন রোগীকে স্লিপ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অন্যদিনের তুলনায় আজ রোগী কম।
বাঁশখালী হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে ও সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি বহির্বিভাগে উপস্থিত ছিলেন বাঁশখালী হাসপাতালের আর.এম.ও ডা. তৌহিদুল আনোয়ার, ডা. সবুজ ধর, ডা. হিরক পাল, ডা. শারমিন আক্তার ও জরুরি বিভাগের ডা. জুবরিয়া শারমিন। বহির্বিভাগে রোগীদের ৩ টাকায় টিকেট সংগ্রহ করে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু টিকেট ফি ৩ টাকার স্থলে ৫ টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ হাসপাতালে সকালে কর্তব্যরত ৬/৭ জন নার্স (সেবিকা) দায়িত্ব পালন করলেও রাতের বেলায় জরুরি মুহূর্তে নার্স (সেবিকা) খুঁজে পায় না বলে কয়েকজন রোগী নাম প্রকাশ না করে পূর্বকোণ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছেন।
সরকারি নিয়মনীতি ভেঙে অফিস সময়ে বাঁশখালী হাসপাতাল গেটে পপুলার ফার্মেসিতে রোগী দেখেন কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার টি.এইচ.ও ডা. জাহাঙ্গীর আলম, পেকুয়া হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. হাসান মডার্ন ডায়গনস্টিক সেন্টারে, পেকুয়া হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. আবদুর রহিম মিনি ল্যাবে, কক্সবাজার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আবুল খায়ের আজাদ মেসার্স জনসেবা ফার্মেসিতে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বহিরাগত চিকিৎসকদের ২/৩ জন করে দালাল রয়েছে। দালালরা প্যাথলজি ও ডাক্তারদের রোগী ধরে ৫শ টাকা হারে ফি আদায় করছে। প্যাথলজিতে প্রতি রোগী থেকে ২/৩ হাজার টাকার পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে শতাধিক রোগীর কাছ থেকে লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ প্রতারক দালালদের কারণে রোগীরা হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে বহিরাগত ডাক্তারদের কাছে টাকার বিনিময়ে সকাল বিকাল প্রাইভেট চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছে।
বাঁশখালী হাসপাতালের আর.এম.ও ডা. তৌহিদুল আনোয়ার জানান, বাঁশখালী হাসপাতালে একসময় ৩৩ জন ডাক্তার ছিল। এখন রয়েছে মাত্র ১৩ জন। আজকে (৬ ফেব্রুয়ারি) হাসপাতালে চিকিৎসকদের মধ্যে অনুপস্থিত রয়েছেন ডা. আমিনুল হক, ডা. মুনিরা ইয়াছমিন ও ডা. আয়েশা মুনমুন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে ডা. হাসান আরিফ ও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রোজিনা আহমেদ অনুপস্থিত ছিলেন। আজকে বুধবার (৬ ফেব্রুয়ারি) উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা টি.এইচ.ও ডা. কমরুল আজাদ ছুটিতে রয়েছেন। আর ডা. আমিনুল ইসলাম তারেক প্রশিক্ষণে আছেন। ডা. হাসপাতালে উপস্থিত হোক আর না হোক, অন্যরা সকলে মিলে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন বলে তিনি জানান।
বুধবার অনুপস্থিত থাকা প্রসঙ্গে গতকাল শুক্রবার ডা. মুনিরা ইয়াছমিনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, ওইদিন তিনি সিএল ছুটিতে ছিলেন। তবে ভুক্তভোগীদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক এমন প্রভাবে কিছু ডাক্তার সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন।
বুধবার ছুটিতে থাকা বাঁশখালী হাসপাতালের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা টি.এইচ.ও ডা. কমরুল আযাদ মোবাইল ফোনে বলেন, সরকারি অফিস সময়ে প্রাইভেট রোগী দেখা বন্ধের নিয়ম রয়েছে। তবে অফিস সময়ে রোগী দেখলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। বাঁশখালী হাসপাতাল গেট সংলগ্ন ও চাম্বল বাজারে বহিরাগত চিকিৎসকেরা সকালে প্রাইভেট চেম্বার করে রোগী দেখার বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সরকারি কোন লাইসেন্স ও কাগজপত্র নেই। শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
/পূর্বকোণ! 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ