আবদুল্লাহ কবির লিটন: পদ-পদবী নেই, তবুও বিপুল কর্মী-সমর্থক তাঁর

মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন: সাবেক সাংসদ মরহুম সুলতানুল কবির চৌধুরীর জীবদ্দশায় বাঁশখালী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল; এরমধ্যে একটি ‘সুলতান গ্রুপ’ অপরটি ‘লিটন গ্রুপ’ হিসেবে পরিচিত। বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগের এই দুটি গ্রুপ নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কৌতূহলের শেষ ছিল না। তবে সুলতানুল কবির চৌধুরীর মৃত্যুর পর গ্রুপিং ও প্রতিযোগিতার রাজনীতিতে ভাটা পড়ে; সৃষ্টি হয় আরও কয়েকটি উপগ্রুপ। সুলতানুল কবির চৌধুরীর আমৃত্যু প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র ভাগিনা আবদুল্লাহ কবির লিটন। বর্তমানে তাঁর অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী।

রাজপথ কাঁপানো তুখোড় রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ কবির লিটনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামের বাওয়া স্কুলে। পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে চলে আসেন সেন্ট প্ল্যাসিডস্ হাই স্কুলে। ১৯৭৮ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৮০ সালে সুনামধন্য এই বিদ্যাপীঠ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সারাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সেশনজটের কবলে পড়েন। ১৯৮৫ সালে তিনি স্নাতক পাস করেন। কর্মজীবনে আবদুল্লাহ কবির লিটন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তিনি আবদুল ওয়াহাব স্টিল মিল ও হোসেন থাই এলুমিনিয়াম অ্যান্ড গ্লাস হাউজের মালিক।

পুকুরিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বরুমছড়া গ্রামের বনেদি পরিবার মিয়ার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করা এ ব্যক্তি ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। আবদুল্লাহ কবির লিটনের বাবা এবিএম নুরুল কবির তাঁকে সবসময় উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিতেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যতিক্রমধর্মী এক রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ কবির লিটন। যার কোনও দলীয় পদ-পদবি না থাকলেও মাঠে রয়েছে অগণন কর্মী। বাঁশখালীতে সর্ব মহলে তাকে নিয়ে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। সেটি হচ্ছে — কোনও পদ-পদবিতে না থাকার পরেও কেন এতো কর্মী? এর পেছনের গল্প কী? একুশে পত্রিকাকে এর পেছনের গল্প শুনিয়েছেন আবদুল্লাহ কবির লিটন।

তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার কর্মীরাই তো আমার বন্ধু। আমার প্রতি তাঁদের অগাধ ভালোবাসা আছে বিধায় এতো কর্মী সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রলীগের কর্মীদের বিপদে আমি সবসময় এগিয়ে গিয়েছি। কে কার পেছনে রাজনীতি করে তা দেখিনি। বাঁশখালীর বর্তমান এমপি মোস্তাফিজ সাহেব আমাকে যতই গালাগালি করুক, যতই হিংসা করুক; তার চেয়ে বেশি আমি তাঁকে ভালোবাসবো।’

বাঁশখালীর কয়েকজন চেয়ারম্যান তাঁর হাতেগড়া কর্মী উল্লেখ করে আবদুল্লাহ কবির লিটন বলেন, ‘আমার সৃষ্টি করা চেয়ারম্যান চাম্বলের মুজিবুল হক চৌধুরী, ছনুয়া ইউনিয়নের হারুনুর রশীদ, কালীপুরের অ্যাডভোকেট শাহাদাত আলম, শেখেরখীলের সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন, সাধনপুরের বর্তমান চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন কামাল। এছাড়া সালাহউদ্দিন কামালের পিতা খোন্দকার মো. ছমিউদ্দিনকেও আমি চেয়ারম্যান বানিয়েছিলাম।’

কার হাত ধরে আপনার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানের হাত ধরে আমার রাজনীতিতে আসা। আমার মামার পিছনে (আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু) বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি। আমার মামা আমাকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি বানাতে চেয়েছিলেন। আমার মামা যেখানে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট, সেখানে আমি জয়েন্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব নিতে যাবো কেন? ওনার পেছনে থেকে, ওনার রাজনীতি করা-ই যথেষ্ট মনে করেছি। তাই এই পদ নেইনি। আমার মামাতো ভাই বর্তমানে ভূমিমন্ত্রী। কোনোদিন আমার মামাতো ভাইয়ের সম্মান ক্ষুন্ন হয়; এমন কাজ করিনি।’

বাঁশখালীতে বর্তমানে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ কিনা, এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক কেমন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি, আমাদের এমপি সাহেব মেম্বার চেয়ারম্যান দিয়ে রাজনীতি করেন। জনগণের সাথে তাঁর বিন্দু পরিমাণ সম্পৃক্ততা নেই। জনগণকে সাথে নিয়ে তিনি রাজনীতি করেন না। মেম্বার-চেয়ারম্যান দিয়ে তো রাজনীতি হয় না। কর্মীর কাজ হচ্ছে সাধারণ জনগণকে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করা, জনগণকে কাছে টানা। শেখ হাসিনার আদর্শ আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রচার করা। আর মেম্বার-চেয়ারম্যানরা তাঁদের স্বার্থের বাইরে যাবে না।’

বাঁশখালীর এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী নেতা ছাড়া মিটিং-মিছিল করেন জানিয়ে এ আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘ওনি (মোস্তাফিজ) যেকোনো মিটিং করলে দেখবেন মঞ্চে কোনও নেতা নাই। সব মেম্বার-চেয়ারম্যান। মেম্বার-চেয়ারম্যানদের ওনি দায়িত্ব দেন স্ব-স্ব এলাকা থেকে মিটিংয়ে লোক আনার জন্য। মেম্বাররা টিআর-কাবিখার জন্য বাধ্য হয়ে লোক আনেন। আমার তো টিআরও নাই, কাবিখাও নাই। আমার আছে শুধু কর্মীদের ভালোবাসা। দলের দুঃসময়ে আমি সবসময়ে রাজপথে ছিলাম।’

বাঁশখালীর সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট সুলতানুল কবির চৌধুরীর সাথে আপনার এতো বিরোধ ছিল কেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সুলতান ভাইয়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা মৃত্যুর আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। ওনি আমাকে সবসময় প্রতিপক্ষ মনে করতেন। আচ্ছা বলুন, আপনাকে যদি কেউ প্রতিপক্ষ মনে করে, তখন আপনার করার কিছু থাকে?’

২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে আবদুল্লাহ কবির লিটনের নাম প্রকাশ পায়। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে তাঁর নাম ঘোষণার পর বাঁশখালীর মাঠঘাট পোস্টারে ছেয়ে যায়। পরে দলীয় হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। আবদুল্লাহ কবির লিটনের নমিনেশন বাতিল করে বর্তমান সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে কি কারণে মনোনয়ন হাতছাড়া হলো— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সেটি তো নেত্রী ভালো বুঝবেন। নেত্রীর সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছি।’

বাঁশখালীতে মোস্তফিজুর রহমান চৌধুরীর বাধার কারণে জনসভা করতে পারছেন না জানিয়ে আবদুল্লাহ কবির লিটন বলেন, ‘আমি ডাক দিলে মিটিংয়ে জনতার ঢল নামে। এসব তিনি সহ্য করতে পারেন না। আমার মামার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে যাওয়ার পথে সরলের হইট্টালতলা এলাকায় এমপির নেতৃত্বে গুণ্ডাবাহিনী আমার কর্মীদের ওপর হামলা করেছে। তখন আমার প্রায় ৩০ জন ছেলে আহত হয়েছিল। আমি কোনও মিটিং-মিছিল করি সেটা এমপি সাহেব চান না। যেমন কিছুদিন আগে শেখেরখীলে একটি মিটিং করেছি। মিটিং করার পর এমপির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মাইকে বক্তৃতা করেছেন; আমাকে গাছে ঝুলিয়ে মারবেন। মানুষ কখন এসব কথা বলে? যখন ভয় পায়। পায়ের নিচে মাটি থাকে না।’

নিজেকে ত্যাগী এবং অবহেলিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ত্যাগী। কিন্তু আমি সবসময় অবহেলিত। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি মনে করেছেন আমি বঞ্চিত ও অবহেলিত। তাই ওনার গায়ে থাকা মুজিব কোট খুলে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমি ত্যাগী। কিন্তু দল আমাকে মূল্যায়ন করেনি; সেটির জন্য আমার দুঃখ নেই।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ