মামলা ছাড়াই যুবক আটক, ক্রসফায়ারের হুমকির অভিযোগ

মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই রংপুরের কোতোয়ালি থানায় এক যুবককে ২৪ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট যুবক স্থানীয় পুলিশ কমিশনার বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন।
ওই যুবকের নাম হুসনে জাকির বিন শহিদ সুমন। তিনি লালমনিরহাট সদর উপজেলার নায়েকগড় হারাটী গ্রামের শহিদুল্লাহ সরকারের ছেলে ও সর্বশেষ কম্পিউটার সল্যুশনসের রংপুর শাখা অফিসের রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
হুসনে জাকির রংপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম রেজা ও এসআই মামুনের বিরুদ্ধে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখানোর অভিযোগ করেন। পাশাপাশি তিনি পুলিশের একটি তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলেন।
বুধবার সকালে (২৭ মার্চ) লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন হুসনে জাকির। বিষয়টি নিয়ে বুধবার লালমিনরহাটে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। তাতে অভিযোগের বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। এর আগে গত ২৩ জানুয়ারি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল আলিমের কাছে তিনি লিখিত অভিযোগ দেন। 
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোাহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিটি পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, কম্পিউটার সল্যুশনসের রংপুর শাখা অফিসের রিজিওনাল সেলস ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত থাকার পর আরও বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ আসায় সেই চাকরিটি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন হুসনে জাকির। এতে কম্পিউটার সল্যুশনসের মালিক আবুল হাসান ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে ছাড়পত্র না দিয়েই টালবাহানা করতে থাকেন। এর একপর্যায়ে গত ৯ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রংপুর কোতোয়ালি থানার এসআই মামুন ও এসআই ফেরদৌস রংপুরের ভাড়া বাসা থেকে কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা মামলা ছাড়াই নিজের গাড়িসহ হুসনে জাকিরকে থানায় নিয়ে আসেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, থানায় নিয়ে যাওয়ার পর রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি রেজাউল করিম হুসনে জাকিরকে বলেন, তাঁর কাছে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বাজারে বকেয়া পড়ে থাকা ৪৭ লাখ টাকা কম্পিউটার সল্যুশনসের মালিক আবুল হাসান পাবেন। এ সময় ওসি তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করতে থাকেন। আটকের পরদিন ১০ জানুয়ারি আটক যুবকের বাবা শহিদুল্লাহ সরকারকে রংপুর কোতোয়ালি থানায় ডেকে নিয়ে আসা হয়। এরপর ওই যুবককে ২৪ ঘণ্টা থানা–হাজতে আটক রেখে গালাগালসহ অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন করা হয়। হুসনে জাকিরের ভাষ্য, ছেলের আর্তনাদ ও যন্ত্রণা দেখে তাঁর বাবা শহিদুল্লাহ সরকার ওসির সব কথা মেনে নেন এবং ছেলের নিজস্ব গাড়ি, ব্যাংকের চেক, নগদ ৫০ হাজার টাকা ও স্ট্যাম্পে মিথ্যা স্বীকারোক্তি ওসির কক্ষেই স্বাক্ষর করেন। এরপর ১০ জানুয়ারি রাতে হুসনে জাকিরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ওই অপমান ও ক্ষোভের কারণে হুসনে জাকির ১০ জানুয়ারি রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহননের চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি টের পেয়ে তাঁকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করালে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
হুসনে জাকিরের দেওয়া লিখিত নথি অনুযায়ী, এর আগে এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে ২৩ জানুয়ারি রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বরাবর পুলিশি নির্যাতনের বিষয়ে তিনি লিখিত অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগপত্রে হুসনে জাকির ওসি রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া স্মারকলিপির অভিযোগগুলো বিস্তারিত উল্লেখ করেন। পাশাপাশি এসআই মামুনের বিরুদ্ধে হুসনে জাকিরকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকির কথা বলা হয়। 
এদিকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ের এডিসি শহিদুল্লাহ কাওছারের ওপর ২৩ জানুয়ারি দেওয়া অভিযোগ তদন্তের ভার পড়েছিল। হুসনে জাকিরের অভিযোগ, তদন্তভার পাওয়ার পর এডিসি শহিদুল্লাহ কাওছার নিজ কার্যালয়ে তাঁকে ডেকে নিয়ে তেমন কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলেন, ‘কী রিপোর্ট হবে, তা আপনি কখনো জানতে পারবেন না।’
অন্যদিকে হুসনে জাকির অভিযোগ করেন, পুলিশ কমিশনারের কাছে তাঁর অভিযোগ দেওয়ার কথা জানতে পেরে কম্পিউটার সল্যুশনসের মালিক আবুল হাসান ২৩ জানুয়ারি বাবা শহিদুল্লাহ সরকারকে ফোন দিয়ে অভিযোগটি প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। না হলে তাঁর আরও বড় বিপদ হবে বলে হুমকি দেন। এর পরদিন ২৪ জানুয়ারি হুসনে জাকিরকে আবুল হোসেনের মুঠোফোন থেকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট সদর থানায় শহিদুল্লাহ সরকার তাঁর ছেলের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা চেয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
এ ব্যাপারে কম্পিউটার সল্যুশনসের মালিক আবুল হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, জাকিরের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। জাকির দোষ স্বীকার করে তাঁর ব্যবহৃত গাড়ি, নগদ অর্থ এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার একটি চেক দিয়েছে। ‘থানায় আটকে রেখে নির্যাতন করে জাকিরের কাছ থেকে এসব আদায় করা হয়েছে’ এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশকে মৌখিক অভিযোগ করেছিলাম। তবে ঘটনার সপ্তাহখানেক পরে ঢাকায় মামলা করেছি।’
নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে ওসি রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এই থানা কম্পাউন্ডের বাইরে দুই পক্ষ বসে আপস–মীমাংসা করেছে। এসআই মামুন ও এসআই ফেরদৌস ৯ জানুয়ারি রাতে জাকিরকে তাঁর বাসা থেকে থানায় ধরে নিয়ে আসেন। ১০ জানুয়ারি রাতে জাকির ছাড়া পান। ‘আটক থাকার সময় জাকিরকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে’—এমন অভিযোগের বিষয়ে ওসির ভাষ্য, ‘এ থানায় কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি।’
এসআই মামুন বলেন, ‘ওসির নির্দেশে তাঁকে (হুসনে জাকির) আমি থানায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে এসেছি। তাঁকে কোনো মারধর বা ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়নি।’ মামলা বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া একজন ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টা থানায় আটক রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, ‘আমি কী করব, ওসির নির্দেশ’ বলে এসআই মামুন ফোন কেটে দেন।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান এডিসি শহিদুল্লাহ কাওছার প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার সিদ্ধান্ত নেবেন।
রংপুর বিভাগীয় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবদুল আলিম বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম, (এডিসি শহিদুল্লাহ কাওছার) প্রতিবেদন দিয়ে থাকলে দেখব।’
/প্রথম আলো!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ