শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম বোকা রমা চৌধুরী


চেয়ে নেওয়ার সমাজে, আদায় করে নেওয়ার সমাজে, কেড়ে নেওয়ার সমাজে, লুট করে নেওয়ার সমাজে রমা চৌধুরী একজন অনন্য উদাহরণ হয়ে রইলেন। আর আমরা অসংখ্য বোকারা ভাবতে থাকলাম, হাতে তালি দিতে থাকলাম এই ভেবে যে, এখনও বোকারা আছে, অনেক বোকা আছে, তাই এ দেশের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার নয়।

একজন বৃদ্ধা কীসব ছাইপাশ লেখেন। আমাদের সাহিত্য বা বোদ্ধা মহলে তাঁর কোনো স্থানই নেই। তাঁর লেখার সাহিত্যমূল্য তো দূরের কথা। আর এই বস্তাপচা লেখা নিয়ে নগ্ন পায়ে বই ফেরি করে বেড়ান, নাগরিক সভ্যতায় তো তা কল্পনাও করা যায় না। তার ওপর বই উৎসর্গ করেন তাঁর পোষা বেড়ালকে। সংসার করেন তাদের নিয়ে।
তাঁর সাথে জুটেছে আরেক অপরিণামদর্শী তরুণ আলাউদ্দিন খোকন। কোথায় একটা চাকরি-বাকরি করে জীবন গড়বে তা না, সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এক অখ্যাত বৃদ্ধাকে নিয়ে। এর চেয়ে যে কোনো একজন রাজনৈতিক দলের নেতার পেছনে ঘুরলেও ভাগ্য খুলে যেত এতদিনে। অন্তত একটা টয়োটা গাড়ি থেকে খোকনের নামার দৃশ্য দেখতে পেতাম আমরা চেরাগীর আড্ডাবাজরা।
বোকার হদ্দ আর কি!
এই সাধারণ রমা চৌধুরীকে ডাকলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কী দুঃসাহস তাঁর, বঙ্গভবনেও গেলেন খালি পায়ে। আশ্চর্য। তবে আশ্চর্যের এখনও শেষ কোথায়। খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে কথা বললেন ৪০ মিনিট ধরে। রমা চৌধুরী কাঁদলেন, কাঁদালেন প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁর লেখা বইও উপহার দিলেন প্রধানমন্ত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে সাহায্য করতে চাইলেন। তিনি বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করলেন। কী বোকা! এমন কাণ্ড কেউ করে? মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি বাড়ি নয়, প্লট নয়, পদ-পদবি নয়, টিভি লাইসেন্স নয়, পারমিট নয়, আগামী নির্বাচনে নমিনেশন নয়, স্থাবর-অস্থাবর কিছুই নয়। শুধু প্রধানমন্ত্রীকে দোয়া করলেন আর বললেন তাঁর অনাথ আশ্রমের কথা।
হায় ঈশ্বর, প্রধানমন্ত্রী কস্মিনকালেও এমন হাবাগোবা দেখেছেন কি না সন্দেহ! কারণ এমন দৃশ্য বা ঘটনা দেখতে তো তিনি অভ্যস্ত নন। কারণ তাঁর কাছে যাঁরা যায়, কেউ চায় দলীয় পদ, নমিনেশন, সরকারি খাস জমি, ছেলে-সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যে সরকারি বাড়ি বা প্লট, সুইমিং পুলের পারমিশন অর্থাৎ কোনো না কোনো দাবি বা প্রত্যাশা।
রমা চৌধুরীর এহেন বোকামিতে প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হয়েছেন কি না জানি না, তবে আমাদের মতো অনেক বঙ্গসন্তান অনেক দিন পর বুক ভরে একটু শ্বাস নিতে পেরেছি। এখনও সমাজে তাহলে কিছু মানুষ আছেন নির্লোভ। নিঃস্বার্থ ও উদার।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পরে খুব তাচ্ছিল্যের সাথে যাঁরা তাঁর দিকে তাকাতেন তাঁরাও এখন রমাদির কাছে যাচ্ছেন। খালি হাতে নয়, ফুলের মালা নিয়ে যাচ্ছেন। যারা এতদিন তাঁকে চিনতেনও না তারা এখন তার সঙ্গে ছবি তুলে পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠাচ্ছেন।
হায় সমাজ, ভণ্ড সমাজ। ‘জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’ এই প্রবণতা থেকে জাতি কোনোভাবেই বের হতে পারছে না। পারছে না লোভ, ভণ্ডামি আর লোক-দেখানো দেশপ্রেমের অভিনয় থেকে।
বঙ্গবন্ধুর সহচর, তাঁর নমিনেশন নিয়ে এমপি হওয়া দেশের সবচেয়ে প্রবীণ, অশীতিপর সাংবাদিকও যখন একটি টিভি চ্যানেলের অনুমতি না পেয়ে রাতের পর রাত শেখ হাসিনা আর তাঁর সরকারকে তুলোধুনো করেন তখন তাঁর পাশে নগ্ন পায়ের গরিব, হতশ্রী এই রমা চৌধুরী এক উজ্জ্বল তারার মতো মনে হয়। যিনি এই নষ্ট সমাজের, ভ্রষ্ট সমাজের, লোভী ও স্বার্থপর সমাজের নতুন প্রজন্মের সন্তানের কাছে উদাহরণ হয়ে রইলেন- কীভাবে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যও ঠেলে দিতে হয়, লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে অনুসরণীয় করে তুলতে হয়। যাঁর একটি ঘর নেই, খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই, কোনো অবলম্বন নেই তিনি কী অবলীলায় রাষ্ট্রীয় সুযোগকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে যেতে পারেন নগ্ন পায়ে।
চেয়ে নেওয়ার সমাজে, আদায় করে নেওয়ার সমাজে, কেড়ে নেওয়ার সমাজে, লুট করে নেওয়ার সমাজে রমা চৌধুরী একজন অনন্য উদাহরণ হয়ে রইলেন। আর আমরা অসংখ্য বোকারা ভাবতে থাকলাম, হাতে তালি দিতে থাকলাম এই ভেবে যে, এখনও বোকারা আছে, অনেক বোকা আছে, তাই এ দেশের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার নয়।

লেখক : কবি, সাংবাদিক বাদল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ