দিনে-দুপুরে সড়কে যৌন হয়রানি

যৌন হয়রানির বিরুদ্ধের সোচ্চার হচ্ছেন মেয়েরা

ভরদুপুরে বাসাবো থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মেয়েটি। রাস্তা পার হওয়ার ছলে মধ্যবয়স্ক এক লোক পেছনে এসে দাঁড়ায় এবং মেয়েটির পেছনে হাত দেয়। ঝামেলা হওয়ার কথা চিন্তা করে মেয়েটি রাস্তা পার হয়ে যান। লোকটিও পার হয় এবং আবারও তাঁর শরীরে হাত দেয়। এবার মেয়েটি চুপ না থেকে হাত ধরে ফেলেন। লোকজন জড়ো হলো। পাশেই বাসাবো থানা। লোকটাকে থানায় নেওয়ার চেষ্টা করায় উপস্থিত জনতা তার উদ্দেশে মন্তব্য ছোড়ে, ‘গায়েই তো হাত দিছে। আর তো কিছু করে নাই! পুলিশে কেন দিবেন? ছাড়েন! নষ্টামি করতেছেন কেন?’

গত ২২ মার্চ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বাসায় ফেরার জন্য রিকশা ঠিক করেন। বনানীর কড়াইল বস্তি হয়ে বাসায় যেতে হবে। কিছু দূর যাওয়ার পরে রিকশাচালক গতি পরিবর্তন করেন। সে পথে যেতেই দেখেন, সামনে কিছু ছেলে দাঁড়ানো। চিৎকার করতে করতে তিনি রিকশা থেকে লাফ দিয়ে নেমে যান। রিকশাচালক হাসতে থাকেন। সড়কে আরও কয়েকজন থাকলেও কেউ ফিরেও তাকায়নি।

প্রথম ঘটনাটি গত ১৯ মার্চের। ঘটনার বর্ণনা করে নিপীড়নের শিকার মেয়েটির বোন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এই ঘটনাগুলো প্রতিনিয়তই হচ্ছে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের পাশাপাশি নারীরা এখন নিপীড়নের ঘটনা ফেসবুকে তুলে ধরছেন। তাঁদের সবারই একই কথা, নিপীড়নের শিকার হলে কেউ তো এগিয়ে আসেই না, বরং অপবাদ দেওয়া হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে গেলেও উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়।
আবার পুলিশের সহায়তায় গ্রেপ্তারও হচ্ছে। গত ১৭ মার্চ ‘নিউ ভিশন’ বাসে ইডেন কলেজের এক ছাত্রীকে হেনস্তার চেষ্টা হয়েছিল। বাসে যাত্রী কম থাকায় অস্বস্তি বোধ করছিলেন ওই ছাত্রী। তিনি নেমে যেতে চাইলে বাসের দরজাও রোধ করে দাঁড়ান চালকের সহকারী এবং বাসচালক তাঁকে দরজা আটকে দিতে বলেন। এ সময় ওই দুজনের মতো বাসের দু-চারজন যাত্রীও হাসাহাসি করছিলেন। একপর্যায়ে খামারবাড়ি পৌঁছে বাসটি গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করছে বলে মনে করেন ইডেনের ওই ছাত্রী। তিনি বাসচালকের সহকারীকে ধাক্কা দিয়ে নেমে যান। এ ঘটনায় বাসচালক ও তাঁর সহকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৩ মার্চ রাজধানীর চাঁদনি চক মার্কেট এলাকায় ইডেন কলেজের তিনজন ছাত্রী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। পরদিন মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটছে, সঙ্গে হুমকিওনিপীড়নের শিকার হয়ে নারীরা এখন ঘটনাগুলোকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসছেন। প্রতিদিনই ফেসবুকের নিউজফিডে এ ধরনের স্ট্যাটাস পাওয়া যায়। তবে ভয়ও পাচ্ছেন অনেকে। ফেসবুকে লেখার পরে অনেকে স্ট্যাটাস তুলে নিচ্ছেন বা প্রাইভেসি পরিবর্তন করছেন। কারণ, ভাইরাল হওয়ার পরপরই তাঁরা বিভিন্নজনের হুমকি পাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবারই চায় না। এ রকম একটি আলোচিত ঘটনায় পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়েই মাঠে নামে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। কিন্তু পরিবার মামলা করতে চায়নি।
তানজিলা নাইমাকে টিউশনির জন্য মিরপুর থেকে বনানীতে যাতায়াত করতে হয়। সাত মাস আগে একদিন বাস সৈনিক ক্লাবের সামনে নামিয়ে দেয়। তিনি হাঁটতে থাকেন। তখনই এক লোক তাঁর পেছনে থাপ্পড় দিয়ে চলে যায়। তানজিলাও লোকটির পিছু নেন। আশপাশের লোকজন ওই লোককে ছিনতাইকারী ভেবে ধরে ফেলে। কিন্তু যখন শোনে শরীরে হাত দিয়েছে, সেটা তাদের কাছে কিছুই মনে হয়নি। লোকটাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বুঝতে পেরে তানজিলা লোকটির চোখে-মুখে পিপার স্প্রে ছিটিয়ে দেন। উপস্থিত জনতা এবার মেয়েটিকে মারধর করে এবং গায়ে হাত দেয়। বনানী থানার পুলিশ এসে তাঁকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় যাওয়ার পরে তিনি নিজেই ‘অপরাধী’।
তানজিলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে আটকে রাখা হয়। পরিবারের লোকজন এলে বলা হয় মুচলেকা দিতে নয়তো মামলা করা হবে ওই স্প্রে ব্যবহার করার জন্য। এমনকি মুচলেকায় তারা লিখিয়ে নেয়, ওই লোকের সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। সে যে আমার গায়ে হাতে দেয়, তার কোনো উল্লেখ নেই।’ তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন এ রকম শিকার হচ্ছেন মেয়েরা। সব দেশেই মেয়েরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এ রকম কিছু ব্যবহার করেন। কিন্তু এ দেশে নিপীড়নের শিকার হয়ে পদক্ষেপ নিতে গেলে অপরাধী বানিয়ে দেওয়া হয়।
বাসাবোতে নিপীড়নের শিকার সেই মেয়ের বোন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ভিকটিম ব্লেমিং একটা কালচার হয়ে গেছে। এখন আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বাধ্য হয়েই মেয়েরা ফেসবুকে এগুলো শেয়ার করছে। কিন্তু শেয়ার করলেও বিপদ, উল্টো হুমকি দেওয়া হয়।’ তিনি আরও বলেন, সেদিন হেনস্থাকারীকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাঁচানোর জন্য এবং রিকশার পিছু নিতে গেলে তাঁর বোনকে মোটরসাইকেল দিয়ে পথরোধ করে। এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। প্রতিনিয়তই হচ্ছে। এখন সবাই সাহস করে বলছে। স্ট্যাটাসে স্থান এবং হেনস্থাকারীর বর্ণনা দেওয়ায় তিনি হুমকি পাচ্ছেন।
গত ৭ মার্চ বাংলামোটরে মিছিল থেকে এক ছাত্রীকে নিপীড়নের অভিযোগ আসে। মামলাও হয় সে ঘটনায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ওই একই দিনে আরও কয়েকজন নারী হয়রানির শিকার হওয়ার কথা ফেসবুকে লিখেছেন। ফেসবুকে লেখার পরপরই সবার স্ট্যাটাস ভাইরাল হয়। কিন্তু লেখার পরে অনেকেই তা সরিয়ে নেন। কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, নানানভাবে তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়।
ধারালো কিছু দিয়ে গাঁয়ের জামা কেটে দেওয়াসহ শরীরে আঘাত করার অভিযোগও আসছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিড়ের মধ্যে অপরাধী দ্রুত সটকে পড়েন। চিহ্নিত করা গেলেও সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে না, বরং শিকার হওয়া নারীকে উল্টো অপবাদ দেওয়া হয় বা যানবাহনে থাকলে নামিয়ে দেওয়া হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ধানমন্ডিতে তাঁরই পরিচিত এক মেয়ে বাসে নিপীড়নের অভিযোগ করলে অপরাধীর পক্ষ নিয়ে মেয়েটিকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়।
ঘটনার শিকার একজন নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনা প্রতিদিন হচ্ছে। কেউ বলছে, কেউ বলছে না। বলতে গেলে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু এমন হতে থাকলে আমরা কই যাব? বাংলাদেশ কি নারীবিহীন সমাজ চায়? এই দেশটা মেয়েদের বাসযোগ্য কবে হবে?’
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইদানীং যে বিষয়টা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিষয়গুলো সবার সামনে আসছে দ্রুত। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ পোস্ট দেবে কি না, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি মনে করি, সবারই উচিত মোবাইলে ডিএমপির অ্যাপস ইনস্টল করা। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিকে ফোন দিতে পারে।’
এডিসি নাজমুল ইসলাম ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ৯৯৯–এ ফোন করার কথাও বলেন। এ ছাড়া নিকটস্থ ট্রাফিক পুলিশের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরাসরি পুলিশকে জানানো। এ ছাড়া নিপীড়নের শিকার হলে সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগকেও জানানো যাবে। তাঁরা মাধ্যম হয়ে অপরাধের ধরন অনুযায়ী পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানাবেন। এ ব্যাপারে ডিএমপি কমিশনারের সম্মতি আছে। সাজার বিষয়ে বলেন, যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতাহানির জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অনুযায়ী জরিমানাসহ সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ