খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সরকারি হাই স্কুল

বি,এন ডেস্কঃ
রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই শিফটে মোট শিক্ষক থাকার কথা ৫০ জন। অথচ রয়েছেন মাত্র ২৭ জন। ফলে প্রতি শিক্ষককে দু'জনের সমান শ্রম দিতে হচ্ছে, নিতে হচ্ছে অতিরিক্ত ক্লাস, দেখতে হচ্ছে অতিরিক্ত খাতা। এতে শিক্ষাদানের মান ক্রমশই কমে যাচ্ছে। আবার শিক্ষকদের অনেকেই চেষ্টা-তদবির করছেন এ বিদ্যালয় থেকে ঢাকার স্কুলে বদলি হতে। প্রধান শিক্ষক মো. ইনছান আলী সমকালকে বলেন, জোড়াতালি দিয়ে দুই শিফটের ক্লাস চালিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি। একই চিত্র রাজবাড়ী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়েও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষার মান কমে যাওয়ায় সুনাম এবং আস্থা হারিয়ে ফেলেছে সরকারি বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তীব্র শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার মান রক্ষা করে পাঠদানে ব্যর্থ হচ্ছে এসব স্কুল। এক সময়ের খ্যাতনামা জিলা স্কুলসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্কুলও রয়েছে এগুলোর মধ্যে। এসব স্কুলের শিক্ষক পদায়নেও রয়েছে সমন্বয়হীনতা। ধানমণ্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলে গণিতের শিক্ষক থাকার কথা ছয়জন, রয়েছেন আটজন। অথচ এ বিদ্যালয়ের দুই কিলোমিটারের মধ্যে শেরেবাংলা নগর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েই গণিতের শিক্ষক কম রয়েছে।

সারাদেশে মোট সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে (নতুন জাতীয়করণসহ) ৩৪০টি। টানা সাত বছর এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ছিল। গত বছর থেকে তা আবার শুরু হয়েছে। এই সাত বছরে মৃত্যু অথবা অবসরজনিত কারণে প্রায় দুই হাজার ৮৭৫টি শিক্ষক পদ শূন্য হয়েছে। এ হিসাব এসব স্কুলের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)। ২০১২ সাল থেকে কারিকুলাম ও সিলেবাস পরিবর্তনের কারণে  বিদ্যালয়গুলোতে গত সাত বছরে চারটি নতুন বিষয় চালু হয়েছে। এগুলো হলো- তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি), শারীরিক শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা, চারু ও কারুকলা। এসব ক্ষেত্রেও কোনো বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে নেই। এক বিষয়ের শিক্ষক পড়াচ্ছেন অন্য বিষয়। তথ্যপ্রযুক্তির মতো মৌলিক ও বিশেষ বিষয়ও পড়ানো হচ্ছে অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের ১৫ মে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তায় উন্নীত করেন। এতে শিক্ষক নিয়োগের মূল ক্ষমতা চলে যায় মাউশির বদলে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) হাতে। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পিএসসিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য বার বার অনুরোধ করা হলেও এতদিন তাতে রাজি হয়নি পিএসসি। পিএসসি জানিয়ে দিয়েছিল, নিয়োগ বিধি গেজেট আকারে জারি না হলে এ পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ সম্ভব নয়। ২০ দিন আগে নিয়োগবিধির গেজেট জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩৪০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শূন্য পদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। শিক্ষক সংকটের কারণে এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছেন। মহানগরীর বিদ্যালয়গুলোতে তেমন সংকট না থাকলেও উপজেলা পর্যায়ের স্কুলগুলোতে এ সংকট তীব্র। এছাড়া এসব সরকারি বিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তিসহ নতুন চালু করা বিষয়গুলোর শিক্ষকও নেই। আবার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লাইব্রেরিয়ানের পদ থাকলেও সরকারি বিদ্যালয়ে এ পদটি এখনও সৃষ্টি করা হয়নি।

জানতে চাইলে মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক আবদুল মান্নান সমকালকে বলেন, প্রচুর পদ শূন্য রয়েছে। তারা সরাসরি বিসিএসের নন-ক্যাডার থেকে কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য পিএসসিতে অনুরোধ করেছেন। এর আগে ৩৪তম বিসিএসের নন-ক্যাডারের মাধ্যমে প্রায় ৫০০ শিক্ষক নিয়োগ করা গেছে। তিনি বলেন, সরকারি স্কুলগুলোতে মামলা জটিলতার কারণে শিক্ষকদের পদোন্নতি দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। এ সময় সারাদেশে প্রায় আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষকের পদ শূন্য হয়েছে। এখন তারা পদোন্নতি দেওয়ার কার্যক্রম সব শেষ করেছেন। পদোন্নতি দেওয়া গেলেও শিক্ষক শূন্যতা অনেক পূরণ হবে।

ভয়াবহ শিক্ষক শূন্যতা : মাউশির মাধ্যমিক শাখার তথ্যমতে, ৩৪০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট প্রধান শিক্ষকের পদ ১৭১টি। এর মধ্যে শূন্য রয়েছে ৫৭টি। প্রধান শিক্ষিকার ১৪৮টি পদের ৭৪টিই শূন্য। জেলা শিক্ষা অফিসার (প্রধান শিক্ষকের সমমান) পদের ৬৪টির মধ্যে ২৪টিই খালি। সহকারী প্রধান শিক্ষকের ২৪৮টি পদের মধ্যে ২৪২টিই শূন্য। সহকারী প্রধান শিক্ষিকার ২১৬টি পদের মধ্যে ২১৫টিই শূন্য। আর সহকারী শিক্ষকের ১০ হাজার ৩৫০টি পদের মধ্যে খালি রয়েছে দুই হাজার ২৬৩টি।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. ইনছান আলী সমকালকে বলেন, 'একে তো ২০১২ সাল থেকে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ ছিল, তার ওপরে বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যক্রম পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন বিষয় পড়ানো হচ্ছে, অথচ সে জন্য নতুন নিয়োগ নেই! এতে জগাখিচুড়ি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর সরকারি স্কুলগুলোয় শূন্য পদ না থাকলেও গ্রামের স্কুলে শূন্য পদ তুলনামূলকভাবে বেশি।' এ বিষয়ে মাউশির সহাকারী পরিচালক (মাধ্যমিক) সাখাওয়াত হোসেন বিশ্বাস বলেন, সরকারি স্কুলগুলোতে পদ সৃষ্টির কার্যক্রম চলমান। পদ সৃষ্টি হলে শিক্ষক সংকট কিছুটা কাটবে।
পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তার বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষকের ১১টি পদ শূন্য। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চারটি পদ ১৬ বছর ধরে শূন্য। বহু দেনদরবার করেও কোনো কাজ হয়নি। নিরুপায় হয়ে শিক্ষকদের দিয়েই সব কাজ করাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ১৫শ' ছাত্রকে পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই। পুরনো সব ভবন অকেজো হয়ে গেছে। মাত্র একটি ভবন ব্যবহারোপযোগী।
লালমনিরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান জানান, তার প্রতিষ্ঠানে ১২জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী একজনও নেই। চতুর্থ শ্রেণির পাঁচটি পদের মধ্যে মাত্র একজন নাইটগার্ড আছেন। কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে স্কুল চালানো হচ্ছে।
জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি স্কুলগুলোতে অনেক স্কুলেই এমন অবস্থা দেখা দিয়েছে। শত শত শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র ৪-৫ জন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান চলছে মহেশখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কুতুবদিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, সিরাজগঞ্জ কাজী এমইও উচ্চ বিদ্যালয়, বগুড়া সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়, বান্দারবান রংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও চরভদ্রাসন সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বহু বিদ্যালয়ে।
তিন দশকেও ১৪৩টি বিদ্যালয়ে পদ সৃষ্টি হয়নি : মাউশি জানায়, ৩৪০টি সরকারি হাইস্কুলের মধ্যে ১৪৩টি বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি হয়নি তিন দশকেও! এরশাদ সরকারের আমলে বেসরকারি স্কুল থেকে জাতীয়করণ হওয়া বিদ্যালয়গুলোও এর মধ্যে রয়েছে। পদবিন্যাস অনুসারে, সরকারি একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কমপক্ষে ২৫ জন শিক্ষক থাকার কথা। ডাবল শিফট বিদ্যালয়ে শিক্ষক থাকবেন ৫০ জন। অথচ এই ১৪৩টি বিদ্যালয় তিন দশক আগের সেই ১১ জন শিক্ষক দিয়েই চলছে। নতুন করে পদ সৃষ্টি না হওয়ায় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম রীতিমতো ধুঁকছে। অথচ পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত এসব বিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষার্থী বেড়েছে আরও কয়েক গুণ। এমনই দুটি বিদ্যালয় টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার আবদুল জব্বার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সন্তোষ ইসলামিয়া গভর্নমেন্ট হাইস্কুল।
এ দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমকালের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, পদ সৃষ্টি না হলে কখনোই সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়বে না।
একইভাবে উপজেলা সদরের কোনো সরকারি হাইস্কুলেই পদ সৃষ্টি করা হয়নি। পুরনো কাঠামোতেই চলছে এসব বিদ্যালয়।
পদোন্নতি পাচ্ছেন পাঁচ শতাধিক শিক্ষক : দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত এসব বিদ্যালয়ের ৫২৯ সহকারী শিক্ষককে সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতির প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব শিক্ষকের নামের তালিকাসহ বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনে (পিএসসি) প্রস্তাব পাঠাবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন সমকালকে বলেন, '৫২৯ অথবা ৫২৬ জন পদোন্নতি পাবেন। বিষয়টি চূড়ান্ত করে পিএসসিতে প্রস্তাব পাঠানো হবে।'
সরকারি হাইস্কুল শিক্ষকদের পদোন্নতির নীতিমালা অনুযায়ী ২০১০ সাল পর্যন্ত বিএড ডিগ্রি অর্জনের দিন থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। তবে চাকরিতে যোগদানের দিন থেকে জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হতো না। এ কারণে চাকরিতে যোগ দিয়ে নবীন শিক্ষকরা বিএড করে দ্রুত পদোন্নতি পেতেন। চাকরির যোগ্যতা হিসেবে বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক না থাকায় বঞ্চিত হন বিএড না করা প্রবীণ শিক্ষকরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে নীতিমালাটি সংশোধন করা হয়। নতুন নীতিমালায় চাকরিতে যোগদানের দিন থেকেই জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হয়। তবে বিএড ডিগ্রি থাকাও এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক।
এদিকে, মাউশির নতুন নীতিমালা চ্যালেঞ্জ করে ৭৫ জন সহকারী শিক্ষক ২০১৫ সালের মার্চে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর রিটের রায় দেয় আদালত। রায়ে বলা হয়, ২০১০ ও ২০১১ সালের নিয়োগবিধি সাংঘর্ষিক। ২০১০-এর পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের পক্ষে মত দেন উচ্চ আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা আপিল করেন। গত বছরের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দেন।
সুত্রঃ সমকাল

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ