মানবপাচারের ঘাঁটি বাঁশখালী!

মোহাম্মদ মহিউদ্দিনঃ
ডাকাত ও জলদস্যুর জন্য বিখ্যাত চট্টগ্রামের বাঁশখালী। সাম্প্রতিক সময়ে মানবপাচারের ঘাঁটি হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে। গত ৩ বছরে শুধুমাত্র বাঁশখালী থেকেই সাগর পথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে দুই সহস্রাধিক মানুষ। মালয়েশিয়ায়, লিবিয়া, কানাডাসহ উন্নত দেশগুলোতে বড় অংকের বেতনে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাঁশখালী থেকে প্রতিদিন পাচার হচ্ছে মানুষ। এমন তথ্য খোদ বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তারের। তিনি বলেন, প্রতিদিন বিদেশে মানব পাচারের ২/১টা অভিযোগ আমার কাছে আসছে। এসব অভিযোগ কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর প্রতিবেদন পাঠাই। জেলা প্রশাসক তা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন।


তিনি বলেন, বাঁশখালী উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আমি যোগদান করেছি মাত্র ৫ মাস আগে। যোগদানের পর থেকে মানব পাচারের পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি পাচারের প্রতিবেদন দিয়েছি। এর আগেও অসংখ্য ছিল। তবে মানব পাচারের সঙ্গে যারা যুক্ত শিগগির তাদের খুঁজে বের করা হবে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, বাঁশখালীর সংঘবদ্ধ কয়েকজন মানবপাচারকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। বড় অংকের চাকরির লোভ দেখিয়ে সাড়ে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়ে তারা সাগর পথে মানুষ পাচার করছে। যাদের অনেকেই সাগরে ডুবে মরছে। না হয় বিভিন্ন দেশের জঙ্গলে গিয়ে না খেয়ে উপোসে মরছে। এমন অনেকের ৭-৮ বছর ধরেও খোঁজ পাচ্ছে না স্বজনরা।
তিনি বলেন, গত ৩ বছরে মালয়েশিয়ার বিভিন্নস্থানে আটকে থাকা বাঁশখালীর ২ হাজার মানুষকে দেশে ফেরাতে ইউএনওর মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। মালয়েশিয়া যাবার নামে প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, থানা ও আদালতে অভিযোগ কিংবা মামলা করেও হাতিয়ে নেয়া টাকা উদ্ধার করতে পারছে না। প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের জনপ্রতিনিধি, থানা ও আদালতে দেয়া কয়েকটি অভিযোগ ও মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১৩-১৪ জনের সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারীরা পুরো বাঁশখালীকে মানব পাচারের ঘাঁটি বানিয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- উপজেলার ছনুয়া, শেখেরখীল, পুঁইছড়ি, চাম্বল, শীলকূপ গন্ডামারা ও বাঁশখালী পৌর এলাকার হত দরিদ্র বাসিন্দারা। শেষ সহায় সম্বল বিক্রি করে কিংবা ধারকর্জ করে টাকা পয়সা দিয়েও কেউ কেউ বিদেশে যেতে পারছে না। আবার অনেকে বিদেশে গিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকের হদিস মিলছে না। তবুও থামছে না মানব পাচার।

সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারীদের মধ্যে শেখেরখীলের আহমদ ছফার পুত্র গোলাম নুর কবির চৌধুরী, তার চাচা মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুল আজিজ, ছনুয়ার খুদুকখালী গ্রামের ছালেহ আহমদের পুত্র জামাল উদ্দিন, মো. শফি, গফুর ডাকাত, শেখেরখীলের মৃত বুজরুচ মিয়ার পুত্র মনির মাঝিসহ আরো অনেকেই রয়েছেন। যারা প্রায়ই আত্মগোপনে থাকেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। 

ছনুয়া ইউনিয়নের খুদুকখালী গ্রামের নেজাম উদ্দিনের স্ত্রী সাবিনা আক্তার অভিযোগ করেন, আমার স্বামী নেজাম উদ্দিন ৬ বছর পূর্বে মালয়েশিয়া যান। ওখানে ভালোভাবে টাকা কামিয়ে দেশে পাঠাতো। ওখানকার প্রবাসী আব্দুল আজিজ ও এখানকার তার ভাতিজা গোলাম নুর কবির চৌধুরীর মাধ্যমে আমার দুই ভাই নাছির ও ইসমাইলের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ৩০০ টাকা স্ট্যামেপর মাধ্যমে চুক্তি মোতাবেক ২টি ভিসার আবেদন করি। ভিসা না দিয়ে বিভিন্ন টালবাহানা করলে আমরা স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বিচার দিই। এই খবর পেয়ে আমার প্রবাসী স্বামী নেজাম উদ্দিনকে মালয়েশিয়ায় হত্যা করে লাশ গুম করবে বলে হুমকি দেন। এরপর থেকে মালয়েশিয়া থেকে আমার স্বামীর কোনো খবর পাচ্ছি না। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছি। ছনুয়ার কালা মিয়ার পুত্র জসিম উদ্দিন বলেন, আমাকে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবে বলে গোলাম নুর কবির চৌধুরী ও প্রবাসী আব্দুল আজিজ আমার কাছ থেকে বিভিন্নভাবে ৪ লাখ টাকা নিয়েছে। ভুয়া ভিসা দিয়ে কয়েকদফা বিমান বন্দরে নিয়ে যায়। ওখান থেকে আমাকে বাড়িতে ফিরে আসতে হয়। আমি ওই ব্যাপারে গত ১৩ই নভেম্বর বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছি। আদালত বাঁশখালী থানার ওসিকে মামলাটির তদন্তভার দিয়েছেন।

সরেজমিন আলাপকালে জানা যায়, সংঘবদ্ধ মানব পাচারকারীরা উত্তর জলদীর আব্দুল মোনাফের পুত্র মো. হাসান থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, নাপোড়ার বদি আলমের পুত্র নুরুল আলমের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা, সরলের আব্বাসের কাছ থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা, গন্ডামারার মো. কালু মিয়ার পুত্র মোস্তফা আলীর কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, শেখেরখীলের আহমদ ছফার পুত্র মো. সেলিমের কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকাসহ ৫ শতাধিক মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শেখেরখীল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ইয়াসিন বলেন, গোলাম নুর কবির চৌধুরী ও আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে গত কয়েকদিন আগে ৪/৫ জন মানুষ পৃথক পৃথক অভিযোগ দেয়। আমি তাদের আইনের আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দিয়েছি।

ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হারুন বলেন, ছনুয়ার শতাধিক মানুষ এখন মালয়েশিয়ায় আটকে আছে। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে সচিবের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। পাচারকারীদের শায়েস্তা করা খুবই দরকার। গরিব মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

চাম্বল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে আমার ইউনিয়নের মানুষ নানাভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। সংঘবদ্ধ পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করা না হলে আরো মানুষ এদের ফাঁদে পড়বে।
বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ রেজাউল করিম মজুমদার বলেন, মানব পাচারের অভিযোগ ও আদালতের অনেক মামলা পেয়েছি। ওইসব বিষয় গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। এদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তদন্তের পর যদি অভিযোগ সত্যি হয়, তাহলে পাচারকারীদের কেউ রক্ষা পাবে না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ