বাঙালির সালাম সংস্কৃতি

ফাহমিদা জামানঃ
বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরের পর বছর গণহারে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, অজ্ঞেয়বাদী, নাস্তিক সকল শিক্ষার্থীদের উঠতে, বসতে, হাগতে, মুততে সিনিয়র দেখা মাত্রই "আসসালামু আলাইকুম" বলা লাগে। এইটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে না, প্রায় সমস্ত অফিস আদালতে বস দেখা মাত্র, "স্যার, আসসালামু আলাইকুম এবং ম্যাম, আসসালামু আলাইকুম" বইলা বয়সে কনিষ্ঠ বা পদ মর্যাদায় নিম্নস্থের জিহবার ডগা ব্যথা হইয়া যায়।

এতো বছর ধইরা বাঙালি সংস্কৃতিতে দুইটা আরবী শব্দের এতো বড় আধিপত্য নিয়া কেউ কথা বলে নাই। অন্তত আমার দেখা বা জানামতে এই বিষয়কে মাইনর ধইরা কেউ প্রতিবাদ করে নাই। এই বিষয় কারো চক্ষু বা মাথাব্যথার কারণ হয় নাই। অথচ এই "সালাম সংস্কৃতি" এতো ক্ষুদ্র কোনো বিষয় না। এটা সরাসরি অন্যের মতামত, দর্শন কিংবা ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত হানে।

আমি যদি আমার কথাই বলি, সেটাও কম জঘন্য কিছু না। যখন জানুয়ারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখি, আমাকে যারপরনাই হেনস্থা করার প্রবল চেষ্টা করা হতো আমি সালাম দিই না বলে। প্রচন্ড এ্যারোগেন্ট এবং লাউড বইলা সালাম না দিয়াই চলতে পারতেছি আমি, পারছি আমি। একদিনের এক কাহিনী বলি- টিএসসিতে চা, সিগ্রেট খাচ্ছি আমি আর আমার দুই শ্রেণিবন্ধু Asif Tanzir এবং M M Muzahid Akash। এমন সময় এক সিনিয়র এসে আমাকে বলে, "আপনি ফাহমিদা জামান ফ্লোরা?" আমি তার সাথে আলাপ চালিয়ে পাশে ওদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দিই। ওরা দুজনের কেউই সিনিয়রকে সালাম না দেওয়ায় সিনিয়র বললেন, "তোমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়ররা কিছু শেখায় নাই?" আসিফ কিংবা আকাশ খানিকটা হতভম্ব হয়ে কিছু বলে না দেইখা আমি বলতে শুরু করলাম, "মি. অমুক, আমিও কিন্তু আপনাকে সালাম দিই নি। যে ইসলাম ধর্ম পালন করে না, সে কেনো সালাম দিবে? আপনাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রগণ যদি জুনিয়রদের বাধ্যতামূলক সালাম দেওয়া চর্চা করায়, তাহলে এটা গর্বের না বরং লজ্জার বিষয়। এটাই হওয়া উচিত, যার ইচ্ছা সে সালাম দিবে এবং যার ইচ্ছা হয় না সে দিবে না।" তারপর সেই সিনিয়র আর কিছু কয় নাই কারণ আমার শক্তিশালী যুক্তির পাশে দাঁড় করানোর মতো যুক্তি তার ছিলো না, নাই।

এমন অজস্র কাহিনী আছে সালাম নিয়া। এমনও হয়েছে আমি সিনিয়রদের সালাম দিই না বইলা তারা আমাকে দেখলে, আপু আসসালামু আলাইকুম বলে। অস্বস্তি! বাঙালি মুসলমানদের সমস্যা এখানেই। তারা মনে করেন, তাদের ধর্মই একমাত্র পবিত্র সংবিধান। এইখানে যা আছে, তা ব্যতীত কেউ চলতেই পারবে না। সকল ধর্ম, বর্ণু নির্বিশেষে সকলকে তাদের পবিত্র গ্রন্থ মাইনা নিয়া চলতে হবে। তারা ভিন্ন মত, ভিন্ন সংস্কৃতি নিতে পারেন না। দখলদারিত্ব, জোরজবরদস্তিমূলক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতি তারা বহুকাল ধইরা চর্চা কইরা আসতেছে এবং তাদের এই ধর্মীয় বিধানকে বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য বানায়ে ফেলছে।

অথচ এই বঙ্গদেশে শুধু মুসলিমই থাকেন না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এ্যাগনস্টিক, নাস্তিকও বসবাস করেন। এই বাংলাদেশ যতোটা মুসলমানের , ঠিক ততোটাই হিন্দুরও, বৌদ্ধরও, খ্রিস্টানেরও, অজ্ঞেয়বাদীরও, নাস্তিকেরও। সুতরাং, আপনি মুসলমান হইয়া আমার মতো একজন ধর্ম না মানা অজ্ঞেয়বাদী নাস্তিকের উপর আপনার ধর্মীয় বিধানকে "বাঙালি সংস্কৃতি" বইলা চাপায়ে দিতে পারেন না। উহু, বিবেকহীন, অমানবিক আপনি আপনার ধর্মীয় বিধানসমূহকে "বাঙালি সংস্কৃতি" বইলা আমার উপর চাপায়ে দিলেও আমি তা সজ্ঞানে, সমেরুদণ্ডে প্রত্যাহার করি, প্রতিবাদ করি কারণ আমি আমার অস্তিত্ব, অধিকার নিয়া অধিকতর সচেতন একজন নাগরিক। অন্যদিকে "সংস্কৃতি" কোনো স্থায়ী টার্ম না, পরিবর্তনশীল। সুতরাং, আমার এই না সালাম দেওয়াটাও বহুল চর্চার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি হইয়া যাইতে পারে। আপনাদের উপর অন্যরা অন্যের সংস্কৃতি, অন্যের ধর্ম চাপায়ে দিতে চাইলে সেসবের চর্চা কইরেন না, লাউডলি প্রতিবাদ করেন। অন্যের হয়ে জীবনযাপন করা যায় না, কইরেন না।

পুনশ্চ "চাপায়ে দেওয়া" এবং "স্বেচ্ছায় পালন করা" দুইটা সম্পূর্ণ আলাদা কনসেপ্ট। এইটা বুঝতে চেষ্টা করেন! যদিও আপনি চাইলেই সকল সংস্কৃতি পালন করতে পারেন কিন্তু নিজের যা ভালো লাগে না, বাধ্য হয়ে সেসব কইরেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ