আদালতে খালেদা জিয়ার এক ঘণ্টা

দুর্নীতির একটি মামলায় দণ্ডিত হয়ে এক বছর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যান। আরেকটি দুর্নীতি মামলায় আজ বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। ঘণ্টাখানেক তিনি ছিলেন আদালতে। বেশির ভাগ সময়ই ছিলেন চুপচাপ।

এক বছর আগে দণ্ডিত হওয়ার পর পুলিশের গাড়িতে করে খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালত থেকে কারাগারে নেওয়া হয়। আজও খালেদা জিয়াকে পুলিশের গাড়িতে করে আদালতে নেওয়া হয়। আদালতকক্ষে হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন খালেদা জিয়া।
এক বছরের ব্যবধানে খালেদা জিয়া দুর্নীতির দুটি মামলায় দণ্ডিত হয়েছেন। ইতিমধ্যে একটি মামলায় (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা) হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার দণ্ড বহাল রেখেছেন। আরেকটি মামলায় (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা) বিচারিক আদালত রায়ও প্রকাশ করেছেন। নাইকো দুর্নীতি মামলায় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালতে নিয়মিত শুনানি চলছে। চলতি বছরে সেখানে খালেদা জিয়াকে হুইলচেয়ারে করে তিনটি শুনানির তারিখে হাজির করা হয়েছে।

তিন নেতার সঙ্গে খালেদার আলাপ
সকাল থেকে পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে স্থাপিত আদালত ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সতর্ক প্রহরা। আশপাশের রাস্তায় অবস্থান নেন পুলিশ বাহিনীর সদস্য, মোড়ে মোড়ে রাখা হয় পুলিশের বিশেষ গাড়ি।
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে খালেদা জিয়াকে বহনকারী পুলিশের গাড়ি আদালতের সামনে পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নামানোর পর আদালতে হুইলচেয়ারে বসে ছিলেন খালেদা জিয়া। গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার আসামি খালেদা জিয়া আসার পর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন এজলাসে আসেন। শুরু হয় শুনানি। তখন আদালতে হাজির বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানি এগিয়ে যান খালেদা জিয়ার কাছে। দুজন কথা বলেন দুই থেকে তিন মিনিট।
কী বললেন খালেদা জিয়া, জানতে চাইলাম শহীদ উদ্দীন চৌধুরী অ্যানির কাছে। অ্যানি বললেন, ‘ম্যাডাম জানালেন, তাঁর শরীর বেশি ভালো যাচ্ছে না।’ রাজনীতিকেন্দ্রিক কোনো আলোচনা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।
শুনানির শুরুতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার আদালতকে বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আমরা এই মামলার জব্দ তালিকার কাগজপত্র এখনো হাতে পাইনি। আদালতে আবেদন করেছি। ওই কাগজপত্র ছাড়া আমরা কীভাবে শুনানি করব।’ আদালত তখন খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের জানিয়ে দেন, শিগগিরই তাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পেয়ে যাবেন। শুনানির এই পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদিন এগিয়ে যান খালেদা জিয়ার কাছে। এক থেকে দেড় মিনিট তাঁদের কথা হয়।
দুদকের আইনজীবী (পিপি) মোশাররফ হোসেন কাজলকে অভিযোগ গঠনের শুনানির পক্ষে বক্তব্য দিতে বলেন আদালত। আদালতের অনুমতি নিয়ে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন মোশাররফ হোসেন। আদালতকে তিনি জানান, মামলার এজাহার হওয়ার পর দুদকের তদন্তে উঠে আসে, কীভাবে খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য আসামি গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় জড়িত। মামলার এজাহারে নাম ছিল ১৩ জনের, তদন্তে উঠে আসে ২৪ জনের। এর মধ্যে কয়েকজন (ছয়জন) মারাও গেছেন।
মোশাররফ হোসেন আদালতকে বলেন, গ্লোবাল এগ্রো ট্রেড কোম্পানি বা গ্যাটকো তুলার ব্যবসা করে। কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করার কোনো অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিও একই কথা বলে যে গ্যাটকো কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করার অভিজ্ঞতা নেই। মন্ত্রিসভার ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিও গ্যাটকোকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রধান খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন সাবেক নৌমন্ত্রী আকবর হোসেনের ছেলে ইসমাইল হোসেন সাইমন।
দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের কাজে অনভিজ্ঞ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গ্যাটকোকে ঢাকার কমলাপুর আইসিডি ও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ পাইয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ১৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন।
শুনানি চলার একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার কাছে যান এ মামলার আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। দু-এক মিনিট খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলার পর আবার তিনি তাঁর আসনে গিয়ে বসেন। এরপর খালেদা জিয়ার কাছে যান স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ও মামলার আসামি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
খালেদা জিয়া আজ যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁদের মধ্যে সব থেকে বেশি সময় ধরে (৯ মিনিট) কথা বলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে। এক ঘণ্টার বেশি সময় আদালতে অবস্থান করা খালেদা জিয়া বেশির ভাগ সময় চুপচাপ ছিলেন। তিন কেন্দ্রীয় নেতা ছাড়াও কথা বলেছেন পাঁচজন আইনজীবীর সঙ্গে।
বিএনপির নির্বাচিত সাংসদেরা শপথ নেবেন কি না, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আদালত চত্বরে খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চান না।’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন এমন কয়েকজন নেতার ভাষ্য, বিএনপির নির্বাচিত সাংসদেরা শপথ নিক, তা চান না খালেদা। দল গোছানোর দিকে মনোযোগ দিতে বলেছেন নেতাদের।
বেলা দুইটার কিছুক্ষণ পর বিচারক আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ঠিক করে এজলাস ত্যাগ করেন। এরপর খালেদা জিয়াকে ঘিরে রাখেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। কালো রঙের পুলিশের একটি গাড়িতে করে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া গাড়িতে থেকে আদালতের সামনে দাঁড়ানো বিএনপির নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরীসহ অন্যদের হাত নেড়ে বিদায় জানান।
আদালতে ফাতেমা
খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডাদেশের পর থেকে তাঁর গৃহকর্মী ফাতেমা খাতুন আছেন তাঁর সঙ্গে। প্রতিবারের মতো আজও খালেদা জিয়ার সঙ্গে আদালতে আসেন ফাতেমা। হুইল চেয়ারে বসে থাকা খালেদা জিয়ার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফাতেমা। ৪২ মিনিট খালেদার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার পর খানিকটা দূরে গিয়ে তিনি একটি চেয়ারে বসেন। মিনিট দশেক পর ফাতেমা চেয়ার থেকে উঠে আবার খালেদা জিয়ার কাছে আসেন। শুনানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফাতেমা খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
গ্যাটকো মামলা
২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াসহ ১৩ জনকে আসামি করে গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ১৩ মে খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২৪ আসামির মধ্যে ৬ জন মারা গেছেন। তাঁরা হলেন: খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো, সাবেক মন্ত্রী বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার, এম সাইফুর রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী (মানবতাবিরোধী মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর), চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান অর্থ এবং হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আহমেদ আবুল কাশেম।
অভিযোগপত্র দেওয়ার পর গ্যাটকো মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিট আবেদন করেন খালেদা জিয়া। ২০০৮ সালের ১৫ জুলাই হাইকোর্ট এই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেন ও রুল দেন। ওই সময় থেকে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত ছিল। আর ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট জারি করা রুল খারিজ করে রায় দেন বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ও বিচারপতি আবদুর রবের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
 /প্রথম আলো!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ