জোট নয়, দলীয় প্রার্থী চান আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা

বি,এন ডেস্কঃ
চট্টগ্রাম- ফটিকছড়ি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অর্ধডজনের বেশি। কোন্দলে জর্জরিত এই সংগঠনের নেতাদের মধ্যে একটি বিষয়ে সৃষ্টি হয়েছে কঠোর ঐক্য। সবাই একসুরে কথা বলছেন। তা হলো : আর জোটের প্রার্থী নয়, আওয়ামী লীগ থেকেই প্রার্থী চান তারা। গত সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন নজিবুল বশর মাইজভাারী। এবারো তিনি মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী বলে পূর্বকোণকে জানিয়েছেন।
এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সাংসদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম পেয়ারুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক ফখরুল আনোয়ার, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. শাহজাহান, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাদাত আনোয়ার সাদি এবং জেলা পরিষদ সদস্য আখতার উদ্দিন মাহমুদ পারভেজ।
 
ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান তৌদিুল আলম বাবু, আবু তৈয়বসহ আওয়ামী লীগের একটি অংশ। যাদের সাথে বর্তমান সাংসদের সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু তাদেরকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অপর গ্রুপ হল, উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি। বর্তমান কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে। বহিষ্কৃত অংশের নেতাকর্মীরা ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগের কোন্দলের জন্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকেই দায়ী করেন। সমাবেশে তার সমালোচনা করার পর তারা দল থেকে বহিষ্কার হন। এছাড়াও রয়েছে সাবেক সাংসদ মরহুম রফিকুল আনোয়ারের পরিবার এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলামের মধ্যে বিরোধ। তার মধ্যে রফিকুল আনোয়ারের পরিবার দুই ভাগে বিভক্ত। রফিকুল আনোয়ারের ছোট ভাই ফখরুল আনোয়ার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। আবার রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে খাদিজাতুল আনোয়ার সনিও মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। সনি গতবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। তবে আসনটি তরিকত ফেডারেশনকে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়াও এই আসনে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে গ্রুপউপগ্রুপ রয়েছে।
 
ফটিকছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন মুহুরি পূর্বকোণকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে সংসদ নির্বাচনে অবশ্যই নৌকা প্রতীকের জন্য কাজ করতে চাই। জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে নৌকা প্রতীক দেবেন সবাই মিলে তার বিজয়ের জন্য কাজ করবো। তবে নেত্রীর প্রতি আমাদের দাবি হল, এই আসনে যেন আওয়ামী লীগের একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এখানে আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থী আছে বলেই অনেকে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পাবেন একজন প্রার্থী। শেষ হাসিনার সিদ্ধান্ত এবং দলের প্রতীক হচ্ছে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী দলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। দলীয় সাংসদ না থাকায় আজ সেসব পরিবার অভিভাবকহীন এবং অসহায়। তাদের দেখার কেউ নেই। আমরা চাই এমন একজন নেতা আসুক যার কাছে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী আশ্রয় পায়।
 
বিরোধ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ডেকে বলেছেন, বহিষ্কৃতরা অনুশোচনা করছে। তাদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি। যদিও তারা সংগঠনের ক্ষতি করেছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভুত কাজ করেছে। নেতার নির্দেশে আমরা সব ভুলে তাদেরকে নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছি। উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় অংশগ্রহণের জন্য তাদেরকে চিঠি দিয়েছি। তাদেরকে বলেছি, আপনার দলের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করুন। আপনাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আমরা সবাই মিলে উদ্যোগ নেব। কিন্তু তারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভায় আসেননি। তবে এখনো উপজেলা আওয়ামী লীগ তাদেরকে সাথে নিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। তবে তাদেরকেও আন্তরিক হতে হবে।
বর্তমান সাংসদ নজিবুল বশর মাইজভাারী পূর্বকোণকে বলেন, ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবেই তিনি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ফটিকছড়ি আসন থেকে জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন। নির্বাচন করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি তার রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রার্থী হলে আওয়ামী লীগ সকল ভেদাভেদ ভুলে তার জন্য কাজ করবে।
 
সাবেক সাংসদ নুরুল আলম চৌধুরী বলেন, নেত্রীর কাছে মনোনয়ন চাইব। তিনি সিদ্ধান্ত দিলে অবশ্যই নির্বাচন করবো। মনোনয়ন পেলে তিনি বিজয় নিশ্চিত করতে পারবেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি সকল বিরোধের উর্ধ্বে। দলীয়ভাবে আমার সাথে কারো বিরোধ নেই। তাই সবাই আমার জন্য কাজ করবে।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এটিএম পেয়ারুল ইসলাম পূর্বকোণকে বলেন, ২০০৮ সালে নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। আমার জেতার মত পরিস্থিতি ছিল। অল্প ভোটে হেরেছিলাম নিজ দলের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে। যারা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সাথে হাত মিলিয়ে ফটিকছড়িতে একজন মানবতাবিরোধীকে এমপি বানিয়েছিল। এমপি না হলেও ফটিকছড়ির মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছি উন্নয়ন কাজের মাধ্যমে। ভুজপুর রাবার ড্যাম নির্মাণ, গাড়িটানা নতুন সড়ক নির্মাণ, দুইটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠা, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন, ভুজপুর থানা ভবন নির্মাণসহ শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন করেছি। আরো বেশ কিছু মেগা প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা আছে। নেত্রী যদি মনোনয়ন দেন, এবার জয় নিশ্চিত করতে পারবেন উল্লেখ করে বলেন, ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ ছাড়াও আপামর জনসাধারণ তার সাথেই আছে। রাজনৈতিক জীবন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেই স্কুল জীবন থেকে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক জীবনের চার দশক পার হয়েছে। ১৯৯১ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ফটিকছড়ির আনাচেকানাচে কোথায় কি প্রয়োজন, কোন্ এলাকার মানুষের কি কি উন্নয়ন কাজ করা প্রয়োজন তা তার নখদর্পণে। তাই সাংসদ নির্বাচিত হলে ফটিকছড়ির মানুষের দুঃখ দুর্দশা ঘুচাতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবেন। তাছাড়া ফটিকছড়ির আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সব অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং সমর্থক সবাই চায় এবার যেন এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন পায়। তিনিও সেটাই চান।
 
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক ফখরুল আনোয়ার পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমি চাই এবার ফটিকছড়ি থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দেয়া হোক।সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তার নির্বাচনী প্রস্তুতি রয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন, তার প্রয়াত বড় ভাই ফটিকছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারকে যারা ভালবাসতেন সেসব নেতাকর্মীরা তার সাথে আছে। এটি তার জন্য বাড়তি সুবিধা। আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলে তিনি আসনটি উপহার দিতে পারবেন। একই পরিবার থেকে দুই জনের মনোনয়ন প্রত্যাশার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি চাই আজই দূরত্ব মিটিয়ে ফেলতে। কিন্তু এক পক্ষ থেকে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। উভয়পক্ষ সম্মত হলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
 
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. শাহজাহান পূর্বকোণকে জানান, ফটিকছড়িতে প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মূল্যায়ন হয়নি। এই আসনে আওয়ামী লীগের অবস্থান শক্ত করতে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কিংবা যাদের পরিবার স্বাধীনতার আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে আসছে সেসব পরিবার থেকে উঠে আসা অনেক যোগ্য নেতা এখানে আছে। নেত্রী তাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনয়ন দিতে পারেন। তিনি ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেন, ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের অবস্থান তৈরি করতে অনেকেই নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি নিজেও শিবিরবিরোধী সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেকবার ঝুঁকিতে পড়েছেন। মামলায় জর্জড়িত হয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, এখন কেউ এসে যদি বলে, এটা আমার পিতা বা ভাইয়ের সম্পত্তি। তা কখনোই হয় না। প্রকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকে মনোনয়ন না দিলে আমরা মানব না।
 
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমি অবশ্যই মনোনয়ন চাইব।তিনি বর্তমান সাংসদের সমালোচনা করে বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশের উন্নয়ন করেছেন। সে অনুযায়ী ফটিকছড়িরও উন্নয়ন হয়েছে। কিন্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে একজন সাংসদ বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ফটিকছড়ির এমপি সেই ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই অন্য এলাকা থেকে তুলনামূলকভাবে ফটিকছড়ির উন্নয়ন কম হয়েছে। একই পরিবার থেকে দুইজনের মনোনয়ন চাওয়া নিয়ে বলেন, ‘আমার চাচা ফখরুল আনোয়ারের সাথে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সমস্যা নয়, পারিবারিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছে। যার জন্য তিনি দায়ী।তিনি বলেন, পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা এখন আর সমাধানযোগ্য নয়। তাছাড়া তার প্রয়াত পিতার উত্তরাধিকার হিসেবে তিনিই পারিবারিকভাবে মনোনয়নের দাবিদার বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, উত্তরাধিকার পায় সন্তানরা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাদাত আনোয়ার সাদি পূর্বকোণকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে তিনি জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি সাধারণ মানুষের সুখেদুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। পুলিশ প্রশাসনকে গাড়ি দিয়ে তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়ে এলাকায় আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। তবে এমপি নির্বাচিত হতে পারলে কাজ করার সুযোগ আরো বেড়ে যাবে। তিনি কোনো কোন্দলের মধ্যে নেই উল্লেখ করে বলেন, নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার জন্যই কাজ করবেন
\দৈনিক পূর্বকোণ/

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ