শীর্ষ জামায়াত নেতাদের সন্তানেরা কেউ পড়েনি মাদ্রাসায়


গাজী গোফরানঃ মাদ্রাসা শিক্ষা তথা ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য যারা দিন-রাত ওয়াজ করতেন সেই জামায়াত নেতাদের সন্তানরা কেউ মাদ্রাসায় পড়ে না। শুধু গোলাম আযম নয়, জামায়াতের শীর্ষ নেতাসহ বেশিরভাগ নেতারা নিজেরাও মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেনি। আবার তাদের ছেলে মেয়েদেরও মাদ্রাসার শিক্ষায় শিক্ষিত করেননি। তারা পড়েছেন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ কেউ আবার উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে। শীর্ষস্থানীয় যেসব জামায়াত নেতা তাদের ছেলেমেয়েদের ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত করেননি তাদের মধ্যে আছেন যুদ্ধাপরাধের রায়ে আজীবন কারাদণ্ড-প্রাপ্ত কারাগারে মারা যাওয়া গোলাম আযম, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, কাদের মোল্লা। বিভিন্ন সূত্র ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এইসব তথ্য পাওয়া গেছে।

গোলাম আযম (নভেম্বর ৭, ১৯২২ - অক্টোবর ২৩, ২০১৪): বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অন্যতম গোলাম আযম। তার ছয় ছেলের একজনও মাদ্রাসায় পড়েননি। বড় সন্তান আব্দুল্লাহ হিল মামুন আল আযমী রাজধানীর খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার থেকে অর্থনীতিতে এমএ করেছেন। দ্বিতীয় ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমিন আল আযমী খিলগাঁও গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশত্যাগ করে লন্ডনে নিটিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। তৃতীয় ছেলে আব্দুল্লাহ হিল মোমেন আল আযমী সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে এসএসসি ও রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিকম পাস করেছেন। চতুর্থ ছেলে আব্দুল্লাহ হিল আমান আল আযমী ১৯৭৫ সালে সিলেট সরকারী অগ্রগামী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এসএসসি, ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে এইচএসসি পাস করে ১৯৮০ সালে। পঞ্চম ছেলে আব্দুল্লাহ হিল নোমান আল আযমী ঢাকা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ হিল সালমান আল আযমী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি। এরপর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স করেন।

মতিউর রহমান নিজামী (৩১ মার্চ ১৯৪৩ - ১১ মে ২০১৬): মতিউর রহমান নিজামী চার ছেলে ও দুই মেয়েসহ মোট ছয় সন্তানের জনক। ছোট ছেলে নাদিম তালহা এখনও ছাত্র হলেও বাকি পাঁচ সন্তানই প্রতিষ্ঠিত। সন্তানদের মধ্যে সবার বড় মেয়ে মোহসিনা ফাতেমা। তিনি পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বড় ছেলে ড. নাকিবুর রহমান পড়ালেখা করেছেন মালয়েশিয়ার আন্তজার্তিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ ভালই আছেন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনাতে। দ্বিতীয় ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। রাবেয়া ভূঁইয়া একাডেমিতে আইন বিষয়ে পড়ালেখা শেষ করে লন্ডন গিয়ে বার-এ্যাট-ল’ ডিগ্রী অর্জন করেছেন তিনি। ছেলেদের মধ্যে কেবল নাজিব মোমেনই দেশে অবস্থান করছেন। তিনি বর্তমানে হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত। নিজামীর তৃতীয় ছেলে ডাঃ নাইমুর রহমান খালেদ। পড়াশোনা করেছেন পাকিস্তানের একটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। ছোট ছেলে নাদিম তালহা মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ালেখা করছেন। ছোট মেয়ে খাদিজা পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে লন্ডনের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (২রা জানুয়ারি ১৯৪৮- ২২শে নভেম্বর ২০১৫):জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবাই আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। বড় ছেলে আলী আহমেদ আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ইউনিভার্সিটিতে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছেন। দ্বিতীয় ছেলে আহমেদ আহকিক রাজধানীর মগবাজার আইএস স্কুল কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা নেন। আরেক ছেলে আহমেদ মাবরুর আইএস স্কুল থেকে এসএসসি ও এইচএসসি শেষ করেন। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে অনার্স করার পর আল মানারাত ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজীতে মাস্টার্স করেছেন। একমাত্র মেয়ে তামরিনা রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেন। আল মানারাত ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছেন একমাত্র মেয়েটি।

আব্দুল কাদের মোল্লা (১৪ আগস্ট, ১৯৪৮– ১২ ডিসেম্বর ২০১৩): আরেক শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা জামায়াতের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। তার চার মেয়ে ও দুই ছেলে পড়েছেন আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। কাদের মোল্লার মেয়ে আমাতুল্লাহ পারভীন ইস্পাহানী গার্লস স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে অর্নাস ও মাস্টার্স করেছেন। বড় ছেলে হাসান জামিল এসএসসি পাস করেছেন বাদশাহ ফয়সাল স্কুল থেকে। তেজগাঁও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছেন। আরেক ছেলে আমাতুল্লাহ সায়মিন এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন ইস্পাহানী স্কুল ও কলেজ থেকে। অনার্স করেছেন হোম ইকোনমিক্স কলেজ থেকে। একই কলেজে ফুড এ্যান্ড নিউট্রেশন বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়ন শেষ করেছেন। সেজো ছেলে হাসান মওদুদ রাইফেলস্ পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করে মালয়েশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। আরেক মেয়ে আফতুল্লাহ লারদীন ইস্পাহানী গার্লস স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে বর্তমানে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছেন। ছোট মেয়ে আমাতুল্লাহ নাজনীন ইস্পাহানী গার্লস স্কুল ও কলেজে অধ্যয়ন শেষে একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছেন।

জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের লেখা একটি বইয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি আমার ছেলেদের মাদ্রাসায় দেইনি এজন্য যে আমি তাদের যোগ্য বানাতে চাই।’ তিনি আরেকটি বইয়ে লেখেন, ‘আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের গোটা পরিবেশ একেবারেই ইসলাম বিরোধী।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসলাম ধর্মকে বিক্রি করা জামায়াতের বড় ব্যবসা। ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে পারলেই ইহকাল ও পরকাল দুটোই নিশ্চিত। ইসলামী বিপ্লবের জন্য বাংলাদেশের মানুষকে আধুনিক শিক্ষার বাহিরে গিয়ে শুধুমাত্র দ্বীনি শিক্ষা নিতে হবে। মাদ্রাসায় পড়তে হবে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি আধুনিক শিক্ষার বিপরীতে দ্বীনি শিক্ষার পক্ষে জোর দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু দলটির নেতাদের সন্তানেরা দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে কেউ মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহন করেনি। দ্বীনি শিক্ষার কথা বলে নিজেদের আখের গোছাতে দরিদ্র ঘরের সন্তানদের মাদ্রাসা শিক্ষার দিকে ঠেলে দেয় দলটি। অপরদিকে নিজেদের সন্তানদের শুধুমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সন্তানেরা পড়াশোনা করেছেন অত্যাধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। অথচ তাদের ভাষায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় ‘নাস্তিকতা শিক্ষা’র আখড়া। সেই আখড়ায় যেহেতু তাদের সন্তানেরা পড়াশুনা করেছেন তাহলে তারা কি আর আস্তিক থাকেন?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ