জন্মনিয়ন্ত্রণ-সামগ্রীর সংকটে দেশ, উদ্বেগ

মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকট চলছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মীরা প্রয়োজনের সময় দম্পতিদের কনডম, আইইউডি (ইন্ট্রা ইউট্রাইন ডিভাইস) দিতে পারছেন না। অধিদপ্তর বিভিন্ন এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সংগ্রহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর সংকটে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংকসহ ছয় উন্নয়ন–সহযোগী। তারা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে চিঠি দিয়ে বলেছে, দেশব্যাপী জন্মনিয়ন্ত্রণ–সামগ্রীর মজুত ফুরিয়ে যেতে বসেছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সমস্যায় পড়বে।
সমস্যার ব্যাপকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক নূর-উন-নবী প্রথম আলোকে বলেন, মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার ঘটনা জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে অরাজকতা সৃষ্টি করবে। এটা কোনো মতেই কাম্য নয়। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়বে এবং জনসংখ্যায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মোস্তফা সারোয়ারসহ অন্য কর্মকর্তারা দাবি করেছেন এ সমস্যা সাময়িক। চলতি মাসের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ‍–সামগ্রীর সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। মহাপরিচালক বলেন, উন্নয়ন–সহযোগীদের দেওয়া চিঠির উত্তর খুব শিগগির দেওয়া হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুস সালাম প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে বলেন, জেলায় কনডম ও আইইউডির সরবরাহ নেই। ঠাকুরগাঁও জেলার একটি ইউনিয়নের একজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক মুঠোফোনে জানিয়েছেন, প্রতি মাসে উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে কনডম, আইইউডি সরবরাহ করা হয়। মে মাসে কোনো সরবরাহ যায়নি।
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার একজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শকও প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে বলেছেন, মহেশখালীতে আইইউডি সরবরাহ নেই। ওই জেলার অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, উখিয়া ও রামু উপজেলায় মে মাসে কনডম ও আইইউডি চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম ছিল।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর প্রথম আলোকে যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, গত বছর অক্টোবর থেকে ক্রমান্বয়ে কনডম বিক্রির পরিমাণ কমেছে। সরকারি কর্মসূচির প্রতিটি কনডম ব্যবহারকারীর কাছে ১০ পয়সায় বিক্রি করেন মাঠকর্মীরা। কনডম ছাড়া অন্য সব জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। ওই মাসে মাঠকর্মীরা ১ কোটি ১০ লাখ কনডম বিক্রি করেছিলেন। এ বছর জানুয়ারিতে বিক্রি কমে দাঁড়ায় ৯২ লাখে। ফেব্রুয়ারিতে বিক্রি হয় ৮০ লাখ। মার্চ ও এপ্রিলে কমে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭৫ ও ৬৬ লাখে।
আইইউডি নারীদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী একটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। সারা দেশে প্রতি মাসে এর চাহিদা ২০-২২ হাজার। সরবরাহ না থাকায় গত এপ্রিল মাসে মাত্র ১০ হাজার বিবাহিত নারী এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পেরেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একজন বিভাগীয় পরিচালক বলেছেন, পুরো উত্তরবঙ্গে সরবরাহের সংকট চলছে। যেসব জেলায় বাড়তি কনডম বা আইইউডি আছে, তা অন্য জেলায় পাঠানো হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন, ইউএনএফপিএ, সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি (এসএমসি), বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইপাস ও মেরি স্টোপস জরুরিভিত্তিতে কনডম ও আইইউ দিয়ে সরকারকে সহায়তা করেছে।

অধিদপ্তরের পরিচালক (উপকরণ ও সরবরাহ) মো. আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) প্রতি মাসের চাহিদা অনুযায়ী কনডম সরবরাহ করবে। ইতিমধ্যে আইইউডি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, চলতি মাসের মধ্যেই তা পাওয়া যাবে। মাসের শেষ নাগাদ দেশের সব অঞ্চলে সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

ইউএনএফপিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি, যুক্তরাজ্যের সহায়তা সংস্থা ইউকে এইড এবং পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট এফপি২০২০-এর প্রতিনিধিরা মোহাম্মদ নাসিমকে দেওয়া চিঠিতে বলেছেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে উন্নয়ন সহযোগীরা উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়েছেন। সামগ্রীর মজুত নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির জন্য খারাপ হবে।
১৫ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেওয়া চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, দেশের চাহিদা পূরণ করার মতো কনডম উৎপাদন করার ক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডিসিএলের নেই। সরকার যেন চার কোটি কনডম আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কিনে নেয়। সুপারিশে তাঁরা বলেছেন, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যেন বিমানপথে কিছু আইইউডি আনার উদ্যোগ নেয়। আর আপত্কালীন মজুতের জন্য এই খাতে বরাদ্দ বাড়ায়।
কেন এমন হলো: অধ্যাপক নূর-উন-নবী মনে করেন, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পরিকল্পনা অভাব ও কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতার কারণে এ মজুত ও সরবরাহের সংকট দেখা দিয়েছে।
কাজী মোস্তফা সরোয়ার প্রথম আলোকে বলেছেন, বছর দুই আগে ঢাকার কেন্দ্রীয় ভান্ডারে আগুন লাগলে বিপুল পরিমাণ খাওয়ার বড়ি, ইনজেকটেবল, ইমপ্লান্ট পুড়ে যায়। অধিদপ্তর এগুলো কেনার ওপর জোর দেয়। কিন্তু কমডন ও আইইউডি সংগ্রহে কমতি থাকে।
ওই চিঠিতে উন্নয়ন সহযোগীরা বলেছে, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একটি উচ্চমান প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখান থেকে বিশ্বের শিক্ষা নেওয়ার আছে। মজুত ফুরালে বাংলাদেশের অর্জন ঝুঁকিতে পড়বে এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হারে (সিপিআর) বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী না থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ বাড়বে। ফলে গর্ভপাতের হারও বাড়বে। গর্ভপাত বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ।
অধ্যাপক নূর-উন-নবী বলেন, সংকট এক্ষুনি দূর না হলে ২০২১ বা ২০৪১ সালের যে বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলা হয় তা বাস্তবায়িত হবে না। আর এ পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হয়েছে তার তদন্তের দাবি জানান এ জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ।

সুত্রঃ- প্রথম আলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ